কাজিরবাজার ডেস্ক :
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে দেশজুড়ে চলছে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ। সরকারি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে করোনার সংক্রমণ রোধে ভার্চুয়ালি সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কাজ চলছে। একইভাবে চলছে নিম্ন আদালতের বিচারকাজ। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজও চলছে একেবারে সীমিত আকারে।
গত বছর ট্রাইব্যুনালে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ২২ সদস্যের ক্রমান্বয়ে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর পুরো ট্রাইব্যুনাল লকডাউন ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ছয়জন প্রসিকিউটর করোনায় আক্রান্ত হন। যদিও বর্তমানে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ছাড়া অন্যরা এখন সুস্থ। গত বছরের মতো এবার লকডাউন ঘোষণা করা না হলেও ট্রাইব্যুনাল থাকছে বিধিনিষিধের আওতায়।
এ পরিস্থিতিতে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব কমলে বা সরকার বিধিনিষেধ তুলে নিলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও বিচারকাজ পুরোদমে শুরু হবে বলে আশা ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও কর্মকর্তাদের।
২০২০ সালে মহামারি শুরু হলে এবং একজন বিচারক অসুস্থ থাকার কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। সে বছর কোনো মামলার রায় ঘোষণা করা হয়নি।
তখন যেসব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ, অভিযোগ গঠন ও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়ার পর্যায়ে ছিল, সেগুলোতে পরবর্তী দিন ধার্য করা ছাড়া কোনো বিচারিক আদেশ দেয়া হয়নি। দীর্ঘ বিরতির পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন মামলার শুনানি চলবে বলে জানানো হয়। সেই সীমিত আকারেই চলছিল কার্যক্রম। এ বছরের শুরুর দিকেও সীমিত পরিসরে ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছিল।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি একটি মামলার রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ওই মামলায় ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ৯ আসামির মধ্যে তিনজনের আমৃত্যু কারাদণ্ড, পাঁচজনের ২০ বছর করে কারাদণ্ড ও আব্দুল লতিফ নামে একজনকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।
এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি ঠাকুরগাঁওয়ের আবেদ হোসেনকে চিকিৎসার শর্তে জামিন দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামির জামিন আবেদনের শুনানি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।
এর মধ্যে মার্চের শেষ দিকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেয়। থমকে যায় ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম। সেই অবস্থা এখনো স্থবির করে রেখেছে ট্রাইব্যুনালকে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়। সেই শিথিল লকডাউন ছিল অনেকটাই অকার্যকর। পরে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আট দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়। পরে আরও কয়েক দফা লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ৬ জুন মধ্যরাত থেকে ১৬ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়িয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা করা হয়। অবশ্য, জাতীয়ভাবে ঘোষিত বিধিনিষেধে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকার লকডাউনে কড়াকড়ি রাখছে স্থানীয় প্রশাসন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ‘গত বছরের মতো এবার নিরাপত্তাকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত না হলেও আমাদের প্রসিকিউশনের কয়েকজন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। যদিও তারা এখন সুস্থ। ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ আগের মতোই চলছে।’
জানা যায়, চলতি বছর ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী করোনা আক্রান্ত হন। চিকিৎসা শেষে তিনি এখন বাসায়। ২০২০ সালে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার স্ত্রী মারা গেছেন। ওই বছরের জুনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ও তার স্ত্রী। চিকিৎসা শেষে সুস্থ আছেন তারা। প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা, সাঈদুর রহমান, আবুল কালাম ও মো. মোশফেকুর রহমান করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন।
বর্তমানে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন প্রসিকিউটর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট জেয়াদ আল মালুম (৬৭)। তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন।
ট্রাইব্যুনালে ৩৬ মামলা
জানা গেছে, এখনো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৬টির বেশি মামলার বিচারিক কাজ চলমান। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিচার চললেও ২০১৩ সাল থেকে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে মোট ৪২টি মামলার রায় আসে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও ৩৬টি মামলা অভিযোগ আমলে নেয়া, অভিযোগ গঠন (ফরমাল চার্জ), সাক্ষ্যগ্রহণের মতো অবস্থায় বিচারাধীন। ইতোমধ্যে ৭৮টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। আরও দু-তিনটি মামলায় তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পস্তুত করা হয়েছে।
আপিল বিভাগে প্রক্রিয়াধীন আবেদন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় ঘোষণার পরে ওইসব রায়ের বিরুদ্ধে করা আবেদনগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। আরও দুটি মামলা সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
লকডাউনের কারণে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের পক্ষে করা রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) আবেদন বিচারাধীন। এই দুজনের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের রিভিউ আবেদন শুনানি পেন্ডিং রয়েছে। এছাড়া আপিল রয়েছে ২০টিরও বেশি।
প্রসিকিউটররা জানান, করোনার প্রভাব কমার পরে দেশের আদালতের কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু হলেও গত ৮ আগস্ট থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমও শুরু হয়। তখন থেকে জামিন শুনানিসহ মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্কসহ অন্যান্য আইনি বিষয়ের জন্য নতুন করে শুনানির তারিখ নির্ধারণ হচ্ছিল। এখন সেই কার্যক্রমও বিঘ্নিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ণ্ডবলেন, ‘করোনার প্রভাবে সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্কসহ অন্যান্য আইনি বিষয়ের জন্য নতুন করে শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে আদালত থেকে। আশা করি শিগগিরই স্বাস্থ্যবিধি মেনে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য, জব্দ তালিকা শনাক্তকরণ, ব্যক্তির সাক্ষ্য, আসামিদের গ্রেফতারি পরোয়ানা সংক্রান্ত আবেদন ও আদেশ এবং জামিন শুনানি, এসব বিষয় পুরোপুরি চালানো সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে প্রসিকিউটর মো. মোখলেসুর রহমান ণ্ডবলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর শুনানি না করে শুধু তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। আশা করি লকডাউন উঠে গেলে কোর্ট খুলতে পারে। আগে জীবন, পরে কাজ। জীবন বাঁচলে কাজ করা যাবে।’
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম. সানাউল হক এ বিষয়ে ণ্ডবলেন, ‘লকডাউনের কারণে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম তেমন চলছে না। শুধু মামলার তারিখ নির্ধারণ ও গ্রেফতারি পরোয়ানা সংক্রান্ত আবেদন ও আদেশ এসব চলছে। আশা করি শিগগিরই ট্রাইব্যুনালের শুনানি পুরোপুরি চালানো সম্ভব হবে। এছাড়া আমরা আরও দু-তিনটি মামলার তদন্ত চূড়ান্ত করেছি। সেগুলোর প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হবে।’
প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল ণ্ডবলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় সরকার ঘোষিত লকডাউনে ট্রাইব্যুনালের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব না হলেও শুধু তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। আমাদের সাক্ষী ও অন্যান্য সবাই সুস্থ আছেন। তাদের খোঁজ রাখা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে অন্য দুই প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি ও রেজিয়া সুলতানা চমন ণ্ডবলেন, ‘কোর্ট আগের মতো চলছে না। আশা করি লকডাউন তুলে নিলে আদালত আবারও আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হবে।’
কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসুস্থতাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের আইটি এক্সপার্ট খন্দকার মেহেদী মাসুদ ণ্ডবলেন, ‘বর্তমানে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। এছাড়া আমাদের কেউ অসুস্থ বোধ করলে তাদের কোর্টে আসতে বারণ করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি পালন করে ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস করেন।’