হেফাজতের নতুন কমিটিতে ঠাঁই পেলেন না কারাবন্দি ও বিতর্কিতরা ॥ বহাল থাকলেন বাবুনগরী

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিলুপ্তির প্রায় দেড় মাস পর নতুন কমিটি ঘোষণা দিলো আলোচিত-সমালোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ৩৩ সদস্যের এই কমিটির আমির ও মহাসচিব পদে রয়েছেন মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী ও মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী। তারা আগের কমিটিরও আমির-মহাসচিব ছিলেন। আহ্বায়ক কমিটিও ছিল তাদের নেতৃত্বে। তবে মূল দুই পদে পরিবর্তন না এলেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে নতুন কমিটিতে। বাদ পড়েছেন বিতর্কিত ও রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত নেতারা। এমনকি হেফাজত ইস্যুতে কারাগারে যাওয়া নেতাদের কেউই স্থান পাননি নতুন কমিটিতে।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে খিলগাঁও চৌরাস্তায় মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটি ঘোষণা করেন মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী। কমিটি ঘোষণাকালে উপস্থিত ছিলেন না আমির মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী। তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রিসোর্টকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার মাওলানা মামুনুল হক হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব এবং ঢাকা মহানগরীর সদস্য সচিব ছিলেন। আগের কমিটিতে তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। নিজের বলয় ও সংগঠনের অনেককে জায়গা করে দিয়েছিলেন হেফাজতের কমিটিতে। নতুন কমিটিতে বিতর্কিত এই নেতা এবং তার কোনো অনুসারীকে রাখা হয়নি।
আগের কমিটিতে প্রাধান্য ছিল ২০ দলীয় জোটভুক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিসের অনেক নেতাও জায়গা করে নিয়েছিলেন কথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে। নতুন কমিটিতে রাজনৈতিক ছাপ আছে এমন আলেমদের বাদ দেয়া হয়েছে। খেলাফত আন্দোলনের একাংশের সভাপতি মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী ছাড়া রাজনৈতিক কোনো ফিগার নেই নতুন কমিটিতে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বলয়ের লোকদের জায়গা দিতে গিয়ে বিলুপ্ত কমিটি করা হয়েছিল ডাউস সাইজের। দেড় শতাধিক সদস্যের সেই কমিটিতে সরকারবিরোধী বলয়ের লোকদের প্রাধান্য ছিল। তবে নতুন কমিটিতে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক ও কিছুটা ক্লিন ইমেজের লোকদের রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া কমিটির আকারও করা হয়েছে ছোট।
আগের কমিটিতে ছিলেন এমন আলোচিত ও প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে বাদ পড়েছেন মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, আহমদ আবদুল কাদের, শাহিনুর পাশা চৌধুরী, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, জালালুদ্দিন, আতাউল্লাহ আমিন, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী, বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, জাকারিয়া নোমান প্রমুখ।
নতুন কমিটিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা ইউসুফকে রাখা হয়েছে সহকারী মহাসচিব হিসেবে। এছাড়া আল্লামা শফীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে রাখা হয়েছে নায়েবে আমির হিসেবে। তবে তাদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না কমিটি ঘোষণার সময়। সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, তারা এই কমিটিতে থাকবেন না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।
কারাবন্দি নেতাদের কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, আপনারা কি তাদেরকে অপরাধী মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে হেফাজতের মহাসচিব বলেন, ‘অপরাধী মনে করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। আমরা বারবার তাদের মুক্তির দাবি করেছি। তাদের ওপর যেন শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন না করা হয় সেটি নিয়ে কথা বলেছি। এমনকি নির্যাতন না করা এবং তাদের দ্রুত মুক্তির দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা তাদের মুক্তির দাবি করছি। নতুন কমিটিও তাদের মুক্তির দাবি চালিয়ে যাবে।’
নতুন কমিটিতে স্থান পেলেন যারা
নতুন কমিটিতে নায়েবে আমির হিসেবে রয়েছেন মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা আবদুল হক মোমেনশাহী, মাওলানা সালাহ উদ্দিন (নানুপুরী), অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী (দেওনা পীর), মাওলানা মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ী, সিলেট), মাওলানা ইয়াহইয়া (হাটহাজারী মাদ্রাসা), মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস (ফরিদাবাদ মাদ্রাসা), মাওলানা তাজুল ইসলাম (পীর সাহেব ফিরোজশাহ্), মাওলানা উবায়দুর রহমান মাহবুব (বরিশাল), মাওলানা মুফতি জসিমুদ্দীন (হাটহাজারী মাদ্রাসা)।
যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, মাওলানা সাজিদুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মাওলানা আবদুল আউয়াল (নারায়ণগঞ্জ), মাওলানা আরশাদ রহমানী (বসুন্ধরা), মাওলানা লোকমান হাকিম (চট্টগ্রাম), মাওলানা আনোয়ারুল করীম (যশোর)।
সহকারী মহাসচিব পদে দায়িত্ব পেয়েছেন- মাওলানা আবু তাহের নদভী (পটিয়া, চট্টগ্রাম), ইউসুফ মাদানী (সাহেবজাদা আল্লামা আহমদ শফী), এছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মাওলানা মীর ইদরিস (চট্টগ্রাম)। সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মাওলানা মাসউদুল করীম (টঙ্গী, গাজীপুর), মাওলানা শামসুল ইসলাম জিলানী (কুমিল্লা)। অর্থ সম্পাদক পদে মুফতি মুহাম্মদ আলী মেখল। সহ-অর্থ সম্পাদক হিসেবে আছেন- মুফতি হাবীবুর রহমান কাসেমী (নাজিরহাট), মাওলানা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ আজহারী (উত্তরা, ঢাকা) প্রচার সম্পাদক পদে মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী (সাভার, ঢাকা)। সহ-প্রচার সম্পাদক- মাওলানা খোবাইব (জিরি)। দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক নাজমুল হাসান (উত্তরা, ঢাকা)। সহ-দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক- মাওলানা ওমর ফারুক (নোয়াখালী)। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক- জাকারিয়া মাদানী (চট্টগ্রাম)।
কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে মাওলানা মুবারক উল্লাহ্ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মাওলানা ফয়জুল্লাহ (পীর সাহেব মাদানী নগর), মাওলানা ফোরকান উল্লাহ খলীল (দারুল মাআরিফ, চট্টগ্রাম), মাওলানা মুশতাক আহমদ (খুলনা), মাওলানা রশীদ আহমদ (কিশোরগঞ্জ), মাওলানা আনাস (ভোলা) ও মাওলানা মাহমুদুল হাসান ফতেহপুরী।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম প্রথমবারের মতো ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে ওই বছরের ৬ এপ্রিল সংগঠনটি ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে। তাদের এই শোডাউন ব্যাপক নজর কাড়ে বিভিন্ন মহলের। তবে এর ঠিক এক মাস পর ৫ মে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে শাপলা চত্বরে অবস্থানকালে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পালাতে বাধ্য হন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এরপর সংগঠনটি অনেকটা চুপসে যায়।
হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। পরবর্তী সময়ে দেশের শীর্ষ এই আলেমের সরকারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। তার নেতৃত্বেই কওমি মাদ্রাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদের সরকারি স্বীকৃতি পায়। এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরিয়া মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধিও দেন আলেম-উলামারা।
আল্লামা শফী ইন্তেকাল করেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। তার ইন্তেকালের পর কাউন্সিলের মাধ্যমে হেফাজতের আমির নির্বাচিত হন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, যিনি আল্লামা শফীর কমিটির মহাসচিব ছিলেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আলেমরা প্রাধান্য পান। মূলত তাদের কারণে হেফাজত ধীরে ধীরে সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায় এবং নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। তিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলা নাশকতা ও তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হেফাজতের অর্ধশতাধিক নেতা এখন কারাগারে রয়েছেন।