কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিজেদের ভাষ্যের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তো রাজপথে সক্রিয়তা দেখাতে পারেইনি, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতেও কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। দীর্ঘ সময় খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বক্তৃতা-বিবৃতিতে হুমকি-ধমকির মধ্যেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ রেখেছে। এর মধ্যে দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে খালেদা জিয়ার পরিবার সরকারের কাছে তার মুক্তির আবেদন জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি প্রধানের সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার করোনা শনাক্ত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর আলোচনা ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সরকারের কাছ থেকে সাফল্য আদায় করতে পারেনি বিএনপি। ফলে দেশে রেখেই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে।
বিএনপি প্রধানের কারাগারে যাওয়া থেকে শুরু করে সর্বশেষ করোনা চিকিৎসা পুরো ঘটনাপ্রবাহে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব যে ভূমিকা রেখেছে, সেটাকে ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া বলছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, কারাগারে নেয়ার সময়ের ব্যর্থতা থেকে বিএনপি বেরোতে পারেনি। সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে হয়তো মহামারিকালেও কারাগারে থাকতে হতো সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে।
দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে তার মুক্তির জন্য মানববন্ধন-অনশনের মতো দায়সারা কর্মসূচি পালন করলেও কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। একটা পর্যায়ে সেই মানববন্ধন-অনশন কর্মসূচিও বন্ধ হয়ে যায়। যদিও খালেদার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের কথাও বলছিলেন বিএনপি নেতারা।
কিন্তু রাজপথ-আইনিপথ কোনো পথেই বিএনপি প্রধানকে কারামুক্ত করতে পারেনি বিএনপি। এর মধ্যে বারবার বিএনপি প্রধানের অসুস্থতার কথা বলে আসছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা। বলছিলেন, চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেয়া হোক। তাদের এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারই খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার উদ্যোগ নেয়।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশ জারি করে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়। এই মুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল।
কারামুক্তির পর গুলশানের ভাড়াবাসা ফিরোজায় যান খালেদা জিয়া। তারপর থেকে সেখানেই থাকছিলেন তিনি। ফিরোজায় ওঠার পর থেকে খালেদাকে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা যায়নি। কেবল সেখানে তার খোঁজখবর নিতে যেতে পারতেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও চিকিৎসক এবং স্বজনরা। সেজন্য বিএনপি নেতারা বারবার বলে আসছিলেন, কার্যত কারাবন্দি থেকে গৃহবন্দি হয়েছেন খালেদা জিয়া।
এভাবে দিনাতিপাতকালেই গত ১৪ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন বিএনপি চেয়ারপারসন। অবশ্য করোনা শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সেদিন লুকোচুরি করে বিএনপি। করোনা শনাক্তের রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরও বিএনপি সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, তার করোনা পরীক্ষাই করানো হয়নি। যদিও একদিন পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সংবাদ সম্মেলন করে খালেদার করোনা আক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেন। এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হয়। পুরো বিষয়টির ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি।
করোনা আক্রান্ত খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত চিকিৎসক টিমের অধীনে ফিরোজায় থেকেই চিকিৎসা নিতে থাকেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে ২৭ এপ্রিল তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। তারপর থেকে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন। ৩ মে শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিএনপি প্রধানকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেয়া হয়।
হাসপাতালে তার অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার আবেদন নিয়ে ৫ মে রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের ধানমন্ডির বাসায় যান খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। ৯ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন না। আইনে এর সুযোগ নেই।
যদিও ৬ মে দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সোমবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার অবস্থা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছি। তাকে বিদেশে নিতে পরিবারের ইচ্ছার কথা তুলে ধরেছি। পরিবার চায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে। খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফ থেকে সরকারের অবস্থান জানিয়ে দেয়ার পর ৯ মে রাতেই মির্জা ফখরুল হাসপাতালে যান খালেদাকে দেখতে। সেখান থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমরা নিঃসন্দেহে হতাশ। তার (খালেদা জিয়া) এই চিকিৎসা যথেষ্ট নয়। ওয়ান-ইলেভেনের ধারাবাহিকতায় সরকার খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চায়, এই জন্যই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি চরিতার্থ করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত।’
২৩ মে দুপুরে হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখতে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। আগের মতোই রয়েছেন, এখনো সিসিইউতে আছেন। সেখান থেকে বের হতে পারছেন না। অর্থাৎ ডাক্তার তাকে বের হতে দিতে চাইছেন না।’
রাজনীতি-বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সাম্প্রতিক বছরের ব্যর্থতার তালিকায় সবার আগে থাকবে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তার মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার বিষয়টি। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ঘিরে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং ওই ফ্রন্টের সঙ্গে মিলেই নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি আরও বড় হোঁচট খেয়েছে। সেই হোঁচটের আঘাত স্পষ্ট করেছে বিএনপির দীর্ঘদিনের জোট ২০ দলের শরিকদের সঙ্গত্যাগ। তখন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যায় জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। আবার ওই নির্বাচনের পর তা বর্জন করে ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু সে ঘোষণায় অটল না থেকে তারা আবার নির্বাচিত সদস্যদের (এমপি) সংসদেও পাঠায়। এ নিয়ে জোট ছাড়ে ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপিও।
ঐক্যফ্রন্ট গঠন, সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং সেই নির্বাচনের ফল বর্জন করেও সংসদে যাওয়ার সমালোচনার ক্ষত না সারতেই বিএনপি বিপাকে পড়ল খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে না নিতে পারার ইস্যুতে। দলটির সমমনা বুদ্ধিজীবীদেরই অনেকের মত, দলীয় চেয়ারপারসনের এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও সরকারকে নমনীয় অবস্থানে নিতে বিএনপি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে তাকে মুক্তির আন্দোলনে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনের মাধ্যমে সরকার মানুষের অধিকার হরণ করছে। দেশে আইনের শাসন থাকলে, মানবাধিকার থাকলে খালেদা জিয়ার জামিন আরও আগেই হয়, তাকে কারাগারে যেতে হয় না।’
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন বলেন, ‘সরকার খালেদা জিয়াকে ভয় পায়। তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে সরকারের মূল উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তিনি। তাদের ছলে-বলে-কৌশলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার জন্য খালেদা জিয়া হুমকি। এ কারণে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অংশ এগুলো।’
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি, এক/এগারোর সেনা সরকারের মতোই এ সরকারও খালেদা জিয়াকে রাজনীতিছাড়া করতে চায়।
ফখরুল বলেন, ‘প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি চরিতার্থ করার জন্যই সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দেয়নি। সরকারের এ সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ। ওয়ান/ইলেভেনের ধারাবাহিকতায় সরকার খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চায়। এজন্যই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’