এ যাবতকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড বাজেট সংসদে উপস্থাপন করা হবে ৩ জুন

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্যে আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক বাজেটের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হ্রাস করে শতভাগ বাস্তবমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বাজেট। করোনার টিকা আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান, নিত্যপণ্যের দাম কমানো, কর্মসংস্থান বাড়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগবান্ধব কর ও ভ্যাট নীতি অবলম্বন এবং সাধারণ মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বাড়ানোর মতো চার বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এবারের বাজেটে কোন খাতে বাড়তি করারোপ করা হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী আগামী ৩ জুন জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবেন টাকার অঙ্কে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ দেশের ৫০তম বাজেট।
জানা গেছে, বাজেট চূড়ান্ত করা হলেও শেষ মুহূর্তে কোন খাতে কত বরাদ্দ দেয়া হবে তা নিয়ে ঘষামাজা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। করোনার কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট করতে হচ্ছে। সরকারী ব্যয় বাড়লেও নতুন করে কোন খাতে বাড়তি করারোপ করা হচ্ছে না। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি দিতে বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উদার নীতি অবলম্বন করতে যাচ্ছে। তবে সামর্থ্যবান ও কর প্রদানে সক্ষম এমন লোক ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় নিয়ে আসা হবে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ায় রফতানি খাতে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে তা মোকাবেলায় বিশেষ কৌশল থাকবে আসন্ন বাজেটে। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে আবার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য মজুদ বাড়ানো, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে কর্পোরেট কর কমানোর নির্দেশনা রয়েছে। ঈদের দুদিন আগে গত ১১ মে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী বাজেটের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী বাস্তব ও কল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়নের ওপর সর্বোচ্চ জোর দেন। করোনা থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি তাদের জীবিকা ও আয় উপার্জন যাতে ঠিক থাকে সে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া করোনায় অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং করোনার তৃতীয় ঢেউ যদি আঘাত করে সে বিষয়েও আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ওই সভায় অংশ নেয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, চলমান মহামারীতে মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন কোন খাতে কতটুকু বরাদ্দ দেয়া হবে তা নিয়ে শেষ মুহূর্তের ঘষামাজার কাজ চলছে। এছাড়া নতুন বাজেটে নতুন কোন শুল্ক আরোপ করা হবে না। তবে আগামী অর্থবছরের জন্য করের জাল আরও প্রশস্ত করা হতে পারে। বৈঠকে ব্যাংক ও অন্য সংস্থাকে সহায়তা করার জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স বাড়ানো হবে না বলেও আলোচনা করা হয়েছে। সর্বজনীনভাবে তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর জন্য কর্পোরেট করের হার ২৫ শতাংশ এবং নন-তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর জন্য ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রীর ওপর কর কমানো নিয়েও আলোচনা করা হয়। একই সঙ্গে করোনার কারণে এখন মানুষ সঞ্চয়মুখী হচ্ছে না। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। এ অবস্থায় মানুষকে আবার সঞ্চয়মুখী করতে ব্যক্তিগত আয়ের করমুক্ত সীমা বাড়ানো হবে এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, আগামী বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে এটিই এ যাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড বাজেট। যদিও প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এবারো বাজেটের আকার বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাজেটের আকার বাড়ানোর ওপর যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তার চেয়ে বেশি জরুরী বাজেট বাস্তবায়ন করা। এতে করোনা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে টিকা আমদানির ওপর। এজন্য আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে থোক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকা। যদিও টিকা কিনতে ব্যয় হবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। বড় অঙ্কের এই অর্থসংস্থানে ইতোমধ্যে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সহ অন্তত ১০ টি উন্নয়ন সহযোগী।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন এবং করছাড় দিয়ে ব্যবসাবান্ধব বাজেট দেয়া হবে। এতে করে দেশের রফতানি ও কর্মসংস্থান ঠিক থাকবে। এছাড়া দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এবার ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন, আগামী বাজেট হচ্ছে করোনা মোকাবেলার বাজেট। এ ভাইরাসের হাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ। এ কারণে টিকা আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থাসন এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নের কথা তিনি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বাজেটকে আরও অংশগ্রহণমূলক করতে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছ থেকে মতামত নিয়েছে সরকার। দেশের পাশাপাশি বিদেশে থেকেও অনেকে এবার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত ও সুপারিশ দিয়েছেন। এসব মতামত ও সুপারিশ বাজেট পাসের আগে বিবেচনা করা হবে। করোনায় অনেক মানুষ গরিব হয়ে পড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সম্প্রতি বাজেট সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে বলেন, জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য যদি বাজেটে দেয়া হয়, অবশ্যই তা প্রশংসার দাবিদার। করোনাকালে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে প্রাধান্য দেয়াটাই হতো বেশি সঙ্গত। করোনার কারণে ইতোমধ্যে অনেক মানুষ গরিব হয়ে পড়েছেন। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। তার মধ্যে শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন বেকার। বাজেটে এগুলোকে কীভাবে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, সেটা বড় বিষয়।
জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য ॥ আগামী বাজেটে জীবন ও জীবিকা দুটোকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। করোনা মহামারী থেকে জীবন বাঁচাতে যেমন উদ্যোগ থাকছে, তেমনি জীবিকা রক্ষায় থাকছে নানা প্রণোদনা। জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। করোনার টিকা কেনা, টিকাদান, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সরকার আগামী অর্থবছরের মধ্যে ১০ কোটি মানুষকে টিকা দিতে চায়। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে জীবিকা ঠিক রাখতে কৃষি ও শিল্পোৎপাদন বাড়ানো ও সেবা খাতের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উদ্যোগ থাকছে। অসহায়, দুস্থ মানুষকে আনা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায়। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগামী বাজেটে করোনার টিকাকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে বাজেটে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, প্রথমদিন থেকেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। করোনার টিকা যতদিন না হবে, ততদিন একের পর এক ঢেউ আসতে থাকবে। এছাড়া বাজেটে ঘাটতি সাত থেকে আট শতাংশ করা, আদায়যোগ্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা, প্রণোদনায় এসএমই খাতকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, দারিদ্র্য নিরসনে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। কোভিড-১৯ মহামারী উদ্ভূত সঙ্কট মোকাবেলায় ও এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকা- পুনরুজ্জীবিত করে অর্থনীতিকে দ্রুত পুনর্গঠন এবং অর্থনীতির গতি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। এবারও এই চারটি কৌশল এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। প্রথম কৌশল সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি করা, দ্বিতীয় কৌশল-ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রবর্তন যাতে অর্থনৈতিক কর্মকা- পুনরুজ্জীবিত হয় এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, তৃতীয় কৌশল-হতদরিদ্র ও সাময়িক কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানো এবং চতুর্থ কৌশল হচ্ছে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করতে এ কৌশলটি সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যাতে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কৌশলের আওতায় সরকার সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্বলিত ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজের মূল লক্ষ্য-কোভিডের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক ও রফতানিমুখী শিল্পে কর্মরত কর্মীদের সহায়তা প্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মসৃজন ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি যাতে বাংলাদেশে এ সঙ্কটের কার্যকর উত্তরণ সম্ভবপর হয়। বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে এবার দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে।