কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছরই বাড়ছে। এ অবস্থায় ইলিশের মৌসুমে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে রফতানি করতে চান ব্যবসায়ীরা। রফতানির অনুমতি দিলে এর অপব্যবহার হতে পারে এবং দেশের বাজারে এ মাছের সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাই আপাতত ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই সরকারের।
২০১২ সালের ১ আগষ্ট রমজানে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ রফতানি নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ইলিশ ছাড়া অন্য সব মাছ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই থেকে ইলিশ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রফতানি উন্মুক্ত করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। ইলিশ আমাদের সবারই পছন্দের। এটা রফতানি উন্মুক্ত রাখা যেমন ঠিক হবে না, তেমনি আবার একেবারে বন্ধ রাখাও ঠিক হবে না। প্রয়োজনের তাগিদে কিছু রফতানি হতেই পারে
মাছ রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি ইলিশের চাহিদা রয়েছে। তাদের অল্প পরিমাণে ইলিশ দিতে পারলে এর সঙ্গে অন্য মাছের রফতানিও বেড়ে যেত।
কিছুদিন আগে ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়া যায় কি না, সে বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মৎস্য মন্ত্রণালয় রফতানির অনুমতি না দেয়ার বিষয়ে মত দেয়।
এ বিষয়ে হিমায়িত পণ্য রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘রফতানির ক্ষেত্রে হয় কী, বলে আমাকে এক টন ইলিশ দাও, হাফ টন ইলিশ বা ৫০০ কেজি ইলিশ দাও। এর সঙ্গে বোয়াল, শিং, শোল, কৈ, পাবদা, চিংড়ি দাও। এগুলো নিয়ে একটা মিক্সড কনটেইনার হয়। এমন একটি ইনভয়েস হয় দেড় কোটি টাকার। এর মধ্যে ইলিশের মূল্য হয় ৫-৬ লাখ টাকা। আমরা যখন বলি ইলিশ দিতে পারব না, তখনই এই অর্ডারটি পুরো বাতিল হয়ে যায়। এটা অন্য দেশে চলে যায়। আমরা কিন্তু ইলিশ দিতে না পারার কারণে দেড় কোটি টাকা হারাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘যখন দেড় লাখ, ২ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হতো তখন আমরা ইলিশ রফতানি করতাম। এখন ৬ লাখ টন উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু রফতানি বন্ধ রাখা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রফতানি খুলে দিলে যদি অপব্যবহার করে, তবে সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করুক। নিয়ন্ত্রিতভাবে ইলিশ রফতানি করা হলেও আমাদের মাছ রফতানি আরও বাড়বে। আমাদের রফতানি কমে যাচ্ছে। সামান্য ইলিশ রফতানি করতে পারলে অন্যান্য মাছের রফতানিও বেড়ে যাবে।’
বাংলাদেশ ফিস এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এস এ ওয়াদুদ বলেন, ‘সিজনের সময় আমাদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত ইলিশ রফতানির অনুমতি সরকার দিতে পারে। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর- এ সময়টা ইলিশ ধরার মৌসুম। তখন রফতানির অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই কোটা পদ্ধতিতে এই মাছ রফতানির সুযোগ দিতে হবে। একেবারে উন্মুক্ত করা ঠিক হবে না।’
ঢালাওভাবে রফতানি উন্মুক্ত করলে দেশে ইলিশের সঙ্কট হবে জানিয়ে ওয়াদুদ বলেন, ‘তখন দেশের মানুষ ইলিশ খেতে পারবে না। কোটা ভিত্তিতে রফতানি করলে দেশের মানুষও ইলিশ খেতে পারবে, আবার সরকারও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।’
ইলিশ রফতানির বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ণ্ডবলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে ইলিশ রফতানি করতে চাচ্ছি না। আমরা মৎস্য মন্ত্রণালয়ের কাছে রফতানির বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। ইলিশ রফতানি অ্যালাউ করছি না। দুর্গাপূজার সময় টোকেন অব অ্যামাউন্ট ইলিশ ভারতে দেয়া হয়, তখন ১০ দিন অনুমতি দেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। আমাদের কাছে ইলিশ রফতানির জন্য প্রচুর দরখাস্ত পড়েছে, অনেকেই অ্যাপ্লাই করেছে রফতানি করা যায় কিনা। সে বিষয়ে জানতে আমরা চিঠি দিয়েছিলাম তাদের (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়) মতামত জানতে। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে দেখলাম, রফতানির অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না। এ সুযোগে আবার দাম বেড়ে যাবে।’
গত ৬ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে ইলিশ রফতানি করা যৌক্তিক হবে না। এখনও গ্রামের অনেক মানুষ ইলিশের স্বাদ নিতে পারে না। তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ খাওয়ার সুযোগ করে দিতে চাই। তারপর ইলিশ রফতানির কথা ভাবা যাবে।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ ণ্ডবলেন, ‘রফতানির বিষয়টি পুরোপুরি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়। অনুমোদনও দেয় তারা।’
মৎস্য সচিব আরও বলেন, ‘ইলিশ রফতানি নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, আমরা বাইরের যে দেশগুলোতে মাছ পাঠাই, সেখানে কিছু কিছু ইলিশ পাঠালে অন্য মাছ রফতানি বাড়ে। আমাদের এখন উৎপাদন পর্যাপ্ত, প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টনের মতো। কিছু রফতানি হতে পারে। তবে সেটা নিয়ন্ত্রিতভাবে হওয়া উচিত। সবার জন্য উন্মুক্ত করা ঠিক হবে না। যাতে ভালো রফতানিকারকরা সেটা করেন। এটা আমাদের সাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি।’
তিনি বলেন, ‘তবে এটা নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়নি। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।’
সচিব আরও বলেন, ‘মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রফতানি উন্মুক্ত করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। ইলিশ আমাদের সবারই পছন্দের। এটার রফতানি উন্মুক্ত রাখা যেমন ঠিক হবে না, তেমনি একেবারে বন্ধ রাখাও ঠিক হবে না। প্রয়োজনের তাগিদে কিছু রফতানি হতেই পারে।’