কাজিরবাজার ডেস্ক :
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি উদ্যানটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই পরিচিত। অস্ত্রের সন্ধানে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এ বনাঞ্চলে এর আগে ৬ দফা অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অভিযানে রকেট লঞ্চার, অস্ত্র গোলাবারুদসহ বিভিন্ন ভারী অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ২০১৪ সালের ১ জুন সাতছড়ির গভীর অরণ্যে অভিযান চালায় র্যাব। ওই সময় র্যাব ওই এলাকায় ৩টি বাংকারের সন্ধান পায়। একটি বাংকার থেকে শতাধিক মর্টার সেল, রকেট লঞ্চার, রকেট লঞ্চারের চার্জার, অয়েলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে।
৩ জুনের সফলতার পর র্যাব সেখানে অভিযান অব্যাহত রাখে। ৪ জুন পায় আরও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ পায় তারা। পরে পাওয়া যায় আরও বাংকার। সেখানে ভারতের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের বই ও কাগজপত্র এবং তাদের ক্যাম্প। প্রথম দফার ১৯ দিন অভিযানের পর আরও ৪ দফা অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে র্যাব।
১ জুন থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ দফায় ৩৩৪টি কামান বিধ্বংসী রকেট, ২৯৬টি রকেট চার্জার, একটি রকেট লঞ্চার, ১৬টি মেশিনগান, একটি বেটাগান, ৬টি এসএলআর, একটি অটো রাইফেল, ৫টি মেশিন গানের অতিরিক্ত খালি ব্যারেল, প্রায় ১৬ হাজার রাউন্ড বুলেটসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে র্যাব। ১৬ অক্টোবর প্রথম পর্যায়ে তিনটি মেশিনগান, ৪টি ব্যারেল, ৮টি ম্যাগজিন, ২৫০ গুলির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৮টি বেল্ট ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি রেডিও উদ্ধার করা হয়।
১৭ অক্টোবর দুপুরে এসএমজি ও এলএমজি’র ৮ হাজার ৩৬০ রাউন্ড, ত্রি নট ত্রি রাইফেলের ১৫২ রাউন্ড, পিস্তলের ৫১৭ রাউন্ড, মেশিনগানের ৪২৫ রাউন্ডসহ মোট ৯ হাজার ৪৫৪ রাউন্ড বুলেট উদ্ধার করা হয়। এছাড়া এসএমজি’র ২০টি, এলএমজি’র ৫টি, এসএলআর-এর ৬টি, ত্রি নট ত্রি’র ৪টি, এমএমজি ২টি, পিস্তলের ২৯টি ও জিথ্রি’র ১২টিসহ মোট ৮০টি ম্যাগজিন, ৫টি ওয়াকিটকি ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি রেডিও সেট উদ্ধার করা হয়।
২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে ১০টি হাই এক্সক্লুসিভ ৪০ এমএম এডন্ট-ট্যাংক রকেট উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে ১৩টি রকেট লঞ্চারের শেলসহ বেশকিছু বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।
২০০৩ সালের ২৭ জুন বগুড়ার কাহালু উপজেলায় আনারসের ট্রাকে ১৭৪ কেজি বিস্ফোরক এবং প্রায় ১ লাখ রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র উদ্ধারের পর সাতছড়ি আলোচনায় আসে। তদন্তে উঠে আসে সাতছড়ি থেকেই এসব গোলাবারুদ ও অস্ত্র পাচার হয়ে গিয়েছিল। কাহালুতে গোলাবারুদ উদ্ধারের পর সাতছড়ি থেকে ভারতীয় নিষিদ্ধ ষোষিত এটিটিএফ ও এনএলএফটি জঙ্গি সংগঠনের ক্যাম্প গুটিয়ে নেয় তারা। চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। ধারণা করা হয়, ওই সময় পুলিশের হাতে গোলাবারুদ ও অস্ত্র আটকের পর অবশিষ্ট এসব অস্ত্র থেকে গিয়েছিল।
পরবর্তীতে সুযোগ না থাকায় এসব অস্ত্র তারা সরিয়ে নিতে পারেনি। চট্টগ্রামে আটককৃত ১০ ট্রাক অস্ত্রের সঙ্গে এই অস্ত্রের সাদৃশ্য রয়েছে বলে র্যাব জানায়।
এটিটিএফ’র অর্থের ফাঁদে সাতছড়ির টিপরারা
১৯৯০ সালের দিকে ত্রিপুরাকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পেতে এটিটিএফসহ বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের জন্ম। ভারত সরকারের ভয়ে তখন এই বিদ্রোহীরা লোকালয় ছেড়ে বনে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তে কাটাতাঁরের বেড়া ছিল না। ফলে বিদ্রোহীরা সহজেই বন দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতো।
চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে তারা রীতিমতো ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করতো। দিনের বেলায় তারা প্রকাশ্যেই লোকালয়ে চলাফেরা করতো।
চুনারুঘাটের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, বাজারে তারা আসত এবং বড় মাছটি কিনে নিত। তারা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে চলাফরা করতো। তখনকার সময়ে সেই পরিবহনটি ছিল ব্যয়বহুল। এখানকার সাধারণ লোকজনের সঙ্গে তাদের তেমন সম্পর্ক স্থাপন না হলেও টিপরা সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের একটি ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। কারণ টিপরাদের আদীনিবাস ত্রিপুরায় এবং উভয়ই একই সম্প্রদায়ের লোক। কৌশলগত কারণেই সাতছড়িকে টার্গেট করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তখন সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ছিল না, ছিল গভীর বন। আবার সীমান্ত থেকে খুবই কাছে।
সাতছড়িতে ভিলেজার বা বন জায়গীরদার হিসেবে বাস করে টিপরারা। দিনে বাধ্যতামূলকভাবে বনে ৮ ঘণ্টা কাজ আর রাতে বন পাহারা দেয়। বিনিময়ে বসবাস করার সুবিধা এবং কিছু জমিতে আবাদ করতে ক্ষমতা। যখন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদেরকে অর্থের লোভ দেখায়, তখন তারা সহজেই রাজি হয়ে যায়। অর্থের বিনিময়ে টিপরারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিন। এমনকি সেখানকার আশিষ দেব বর্মা এবং সুব্রত দেব বর্মাসহ বেশ কয়েকজন তাদের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। টিপরা পল্লী ও আশেপাশের টিলায় বাংকার তৈরি করে ভারী অস্ত্র মজুদ করে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থে চেহারা পাল্টে যায় টিপরা পল্লীর।
যখন লোকালয়ে তেমন একটা দালান ঘর ছিল না, তখনই তাদের দালান উঠে। ঘরে সুন্দর ফার্নিচারসহ কোনও কিছুর কমতি ছিল না তাদের।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথম দিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সু-সম্পর্ক রাখলেও এক পর্যায়ে তারা টিপরাদেরকে জিম্মি করে ফেলে। তারা কোনও খবর পাচার হলে মেরে ফেলা হবে বলে ভয় দেখালে নিরবেই সব কিছু মেনে নেয় তারা। কয়েকজন বিশ্বস্থ অনুসারী সৃষ্টি করে তারা।