স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেট মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ ছাত্রাবাসে তরুণীকে ধর্ষণের দুটো মামলার বিচারকার্য একই আদালতে ও একসঙ্গে করার নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে গতকাল রবিবার বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দিয়েছেন।
হাইকোর্টে বাদীপক্ষের আইনজীবী আবদুল কাইয়ূম লিটন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, একই আদালতে একসঙ্গে বিচারকার্য ছাড়াও বিচারক আরও দুটো আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কোনো আসামি আইনজীবী না পেলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে স্টেট ডিফেন্স নিযুক্ত করে বিচারকার্য শুরু করা। অপরটি হচ্ছে ভুক্তভোগী বাদী ও বাদীপক্ষের আইনজীবীদের নিরাপত্তা দেওয়া। হাইকোর্ট নিরাপত্তার বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি রাখা হয়। এই আদালতে রবিবার মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর তারিখ ধার্য ছিল। ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) রাশেদা সাঈদা খানম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় মোট ৫১ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। মামলার বাদীসহ ৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ছিল গতকাল রবিবার। বাদীপক্ষের আইনজীবীরা সাক্ষীদের বিড়ম্বনার কথা বিবেচনায় নিয়ে ও দ্রুত বিচারের স্বার্থে একই আদালতে একসঙ্গে বিচারকার্যের আবেদন উচ্চ আদালতে করার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের বিচারককে লিখিতভাবে জানান।
ট্রাইব্যুনালের পিপি রাশেদা সাঈদা খানম বলেন, বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কথা ছিল। মামলার ৮ জন আসামিকে আদালতে হাজির করে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ার সময় বাদীপক্ষের আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে শুনানির বিষয়টি জানান। বিচারক তখন সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবির আদেশ দেন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এলে মামলার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করার কথা জানান।
বাদীর আবেদনে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া ও আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নিয়োগসহ কিছু অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী। আবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত ৭ ও ৮ নম্বর আসামি আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাহ-উল ইসলামের পক্ষে কোনো আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়নি। তাদের পক্ষে আইনজীবী না পেলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনজীবী নিযুক্ত করে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর কথা। কিন্তু এই ফাঁক রেখে বিচারকার্য সম্পন্ন হলে এই আসামিরা পরবর্তী সময়ে অনুকম্পা পাওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রসঙ্গটি আবেদনে উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে, ‘৭ ও ৮ নম্বর আসামি কোনো ওকালতনামা দেননি। স্টেট ডিফেন্স না করে জবরদস্তি মূলে মামলার বিচার করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে।’
এ ছাড়া সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আবেদনে বলা হয়, আদালতে সাক্ষ্য দিতে এজাহারকারীর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানার আদেশটি এমনভাবে লেখা হয়েছে, যেন এজাহারকারী নিজে কোনো আসামি। বিধান হলো, প্রথমে সমন প্রেরণ। তারপর সাক্ষীর পরোয়ানা, তারপর জামিন অযোগ্য পরোয়ানা। এতে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।
একসঙ্গে বিচারকার্য শুরুর বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদেশে সন্তোষ প্রকাশ করেন মামলার বাদীর আইনজীবী প্যানেলের প্রধান শহীদুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ছাত্রাবাসে তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের আগে তার স্বামীকে (মামলার বাদী) মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে আরও একটি মামলা হয়। ধর্ষণ মামলার আট আসামিই এই মামলার আসামি। এতে ধর্ষণ মামলার ৫১ জন সাক্ষীকেও সাক্ষী রাখা হয়েছে। একই ঘটনার পৃথক দুটি মামলা দুটো আদালতে চললে বিচারকার্য বিলম্বিত হতে পারে। এ ছাড়া সাক্ষীদের দুই আদালতে সাক্ষ্য দিতে হবে এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন বাদী। এ আশঙ্কায় দুই মামলা একই আদালতে রেখে বিচারকার্য একসঙ্গে চালানোর আবেদন করা হয়েছিল।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ২৪ জানুয়ারি সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ দুটি মামলা একসঙ্গে বিচারকাজ শুরু করার আবেদন করা হয়েছিল। এই আবেদনে একজন আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী নিযুক্ত না করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছিল। বিচারকার্য শুরুর আগে কোনো আসামি আইনজীবী না পেলে স্টেট ডিফেন্স দেওয়ার বিধান আছে। এই বিধান না মানলে নিম্ন আদালতের রায় পরবর্তী সময়ে অনুকম্পা পাওয়ার সুযোগ থাকে। আমরা এই বিষয়টিও আবেদনে উল্লেখ করেছিলাম। শুনানি শেষে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর এই আবেদন নিয়ে ওই দিনই উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁরা।
একসঙ্গে বিচারকার্য শুরুর বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদেশ, পাশাপাশি উচ্চ আদালত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আদেশ প্রসঙ্গে শহীদুজ্জামান বলেন, যে বিষয়গুলো আমাদের আবেদনে ছিল, সেগুলো উপস্থাপন করতে গিয়ে নানাভাবে আমরা অসহযোগিতার মুখে পড়েছিলাম। বাদী, ভুক্তভোগী ছাড়াও আমরা আইনজীবীরাও স্বাভাবিকভাবে সন্তুষ্ট। উচ্চ আদালত এ বিষয়ে নজর দেওয়ায় আমরা বাদীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টায় থাকব।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে (২০) দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী বাদী হয়ে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার পর আসামিরা ছাত্রাবাস থেকে পালিয়ে গেলেও তিন দিনের মধ্যে ছয় আসামি ও সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র্যাব। গ্রেপ্তারের পর আটজন আসামিকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পরে সবাই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করেন। আসামিদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষায় আটজন আসামির মধ্যে ছয়জনের ডিএনএর মিল পাওয়া যায়।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।
অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম ওরফে রাজনকে দল বেঁধে ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। আসামি রবিউল ও মাহফুজুরকে ধর্ষণে সহায়তা করতে অভিযুক্ত করা হয়। আট আসামিই বর্তমানে কারাগারে আছেন। তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত।