কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রাণঘাতী করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর জীবনকে সরকার ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে না, একথা আগেই বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, মহামারীর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হলে তখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত হবে। আমরা এখন ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এর মধ্যে যদি অবস্থা ভাল হয়, খোলা হবে। যদি না হয়, আমরা খুলব না। ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রমের উদ্বোধন করে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেছেন। অন্যবছর গণভবনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও মহামারীর মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার এ অনুষ্ঠান হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন। তার পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেন বিভিন্ন পর্যায়ের ২৩ শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেন। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।
রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার প্রায় তিন শ’ শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল এ অনুষ্ঠানে। যাদের সকলেই নতুন বই পেয়েছে। মহামারীর মধ্যে পাঠ্যবই ছাপানো কঠিন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, এবার মহামারীর মধ্যে বিপুলসংখ্যক নতুন বই ছাপানো অনেক কঠিন ছিল। বই বিতরণের সময় এক সঙ্গে যেন বেশি সমাবেশ না হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভাগে ভাগে সবাইকে বিতরণ করাই ভাল। করোনার মধ্যে বই ছাপানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় থেকে আগেই জানানো হয়েছে, করোনা মহামারীর কারণে এবার অন্য বছরের মতো স্কুলে স্কুলে পাঠ্যবই উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধির কথা চিন্তায় স্কুল থেকেই আজ বছরের প্রথম দিন থেকে ১২ দিনব্যাপী বই বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে প্রতিটি শ্রেণীর বই বিতরণের জন্য মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক স্কুলগুলোকে তিন দিন সময় দেয়া হচ্ছে। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বই বিতরণে ১২ দিন সময় পাবে স্কুলগুলো। ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে বই পাঠানো হয়েছে। কর্মকর্তারা প্রধান শিক্ষকদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন। স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীদের বই সংগ্রহ করবেন। স্কুলগুলো আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বই বিতরণের ব্যবস্থা করবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বই আজ জানুয়ারি থেকে বিতরণ শুরু হচ্ছে। স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীদের বই নিতে হবে। বই বিতরণে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শ্রেণীভিত্তিক বুথ করা হয়েছে। একজন শিক্ষক একটি বুথের দায়িত্বে থাকবেন। শিক্ষার্থীরা শ্রেণী ওয়ারি বুথ থেকে বই সংগ্রহ করবে। অনেক উপজেলায় বইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মাস্ক ও হ্যান্ড সেনিটাইজার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টানা বন্ধের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি এই করোনাভাইরাসের কারণে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা। তার কারণ, স্কুল ছাড়া সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকা, এটা যে কত কষ্টকর, এটা সত্যিই খুব দুঃখের। তারপরও ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন শিক্ষার্থীরা যে ঘরে বসে অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যার ফলে অন্তত ছেলেমেয়েরা একেবারে শিক্ষা থেকে দূরে যাচ্ছে না। কিছুটা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে আমরা মনে করি, আমাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, সেখানেও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এবং এটা চলমান থাকবে।
এই মহামারী থেকে কবে মুক্তি মিলবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, পুরো বিশ্ব সেই অপেক্ষাতেই রয়েছে। আমরা যখন একটু সিদ্ধান্ত নিলাম যে স্কুল খুলব, তখন আবার নতুন করে দ্বিতীয় ধাক্কা এলো করোনাভাইরাসের। কাজেই আমরা ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করব। মহামারীর মধ্যে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তা মোকাবেলা করার ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
এবার নতুন বছরে মোট ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আমরা বিনামূল্যে বই দিচ্ছি, যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা হাতে নতুন বই পায়। একটা নতুন বই পেলে একটু ভালও লাগে। বইটা হাতে পাবে, মলাটটা লাগাবে, নামটা লিখবে, সুন্দরভাবে দেখবে, পড়বে। সেটাই একটা আলাদা আনন্দ। সেই আনন্দটা যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা পায়, সেজন্যই আমরা ব্যবস্থা নিই প্রতিবছর। বই বিতরণের সময় এক সঙ্গে যেন বেশি সমাবেশ না হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভাগে ভাগে সবাইকে বিতরণ করাই ভালো।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি ঘরে বসে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর, সময় কাটানোও কষ্টকর। তারপরও খালি পাঠ্যবই না, এমন অনেক বই আছে, পড়া যায়, যা পড়ার জন্য আমি অনুরোধ করব। আর শিক্ষার্থীরা যাতে খেলাধুলা করতে পারে, নিয়মিত কিছুটা রোদে বা খোলা হাওয়ায় যেতে পারে, অভিভাবকদের সেই পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি বাইরে গেলে সবাইকে মাস্ক পরতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বললেন।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তারাই তো একদিন এই দেশে কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ বিজ্ঞানী হবে, কেউ মন্ত্রী হবে, কেউ প্রধানমন্ত্রী হবে। কেউ না কেউ তো কিছু হবে। কাজেই সেভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের প্রত্যেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। দেশে এবং বিদেশেও তারা নাম করবে। শিক্ষা যেহেতু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই সেই শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলব। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
বাংলাদেশের একটি মানুষও যেন ঠিকানাবিহীন না থাকে- সে লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা ভূমিহীন, গৃহহীন তাদেরকে আমরা ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। প্রত্যেকের একটা ঠিকানা থাকবে। প্রত্যেক ঘরে শুধু বিদ্যুতের আলো না, শিক্ষার আলোও যাতে জ্বলে, শিক্ষার আলোও আমরা জ্বালব। সেভাবেই আমরা কিন্তু কাজ করে যাচ্ছি।
করোনাকালীন বিশেষ ব্যবস্থায় এক হাজার ৬৪৬টি স্কুল-কলেজকে এমপিওভুক্তকরণের মাধ্যমে দুই হাজার ৫৫ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও অবসর সুবিধা নিশ্চিত করাসহ এই সময়ে সরকার প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধাদির কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, সাধারণ শিক্ষা ধারার ৬৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃত্তিমূলক কোর্স চালু করে ইতোমধ্যে ৬৭৬ জন ট্রেড ইন্সট্রাকটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঁচ হাজার ৩৫১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ৫১৭ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার টাকা অবসর সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। পাশপাশি পাঁচ হাজার ৪৪৬ শিক্ষক-কর্মচারীর কল্যাণ ভাতার আবেদন নিষ্পত্তি করে ২১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৮ হাজার ১৩৫ টাকা প্রদান করা হয়েছে। সকল ধরনের বৃত্তির অর্থ ‘জিটুপি’ পদ্ধতিতে এক লাখ ৫৯ হাজার ৫২৬ বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে অনলাইনে ‘ইএফটি’ এর মাধ্যমে ‘ব্যাংক এ্যাকাউন্টে’ প্রেরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ৪০ লাখ দরিদ্র শিক্ষার্থীর মাঝে উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে করোনাকালীন পাঠানোর তথ্যও তুলে ধরেন।
তিনি এই শীতকালে লেবু ও কমলালেবুসহ বিভিন্ন ভিটামিনযুক্ত খাবার খাওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। বলেন, সকলে যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, সেজন্য আমি আমাদের অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সকলের প্রতি অনুরোধ জানাব। আর সব সময় ঘরে বসে না থেকে যেকোন সময়ে একটু রোদে বা খোলা বাতাসে থাকতে হবে। এটি আমাদের করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই করোনাভাইরাসের মধ্যেও আমরা সকলের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারলাম। কাজেই, ছোট্ট সোনামণিরা, তোমরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। মানুষের মতো মানুষ হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি এ সময় দেশবাসীকে ইংরেজী নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছাও জানান।
আগামী ১২ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। একই সঙ্গে বলেন, জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আবেদন আহ্বান করা হবে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা চূড়ান্ত হয়েছে। জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আবেদন আহ্বান করা হবে।
দীপু মনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পাচ্ছে। ঘোষণার পর আমাদের মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সহযোগিতায় ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৩৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬১ কপি বই ছাপানো হয়েছে।
তারপর পর্যায়ক্রমে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে ২০১৭ সালে যুক্ত হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্রেল বই, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সার্দ্রি, গারোদের নিজস্ব ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক।
করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এবার আমরা একই দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেব না মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি শ্রেণীর বই বিতরণের জন্য তিন দিন করে সময় দেয়া হবে।