বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ॥ ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না

75
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ভিডিও বার্তায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানীং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। কিন্তু এ দেশে ধর্মের নামে কোন ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আমরা দিব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।
মহান বিজয় দিবস-২০২০ উপলক্ষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, এই বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরাণ, শাহ মকদুম, খান জাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোলো কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের। এ দেশে ধর্মের নামে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। তাই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাঁর সরকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে যত কাজ করেছে, অতীতে কোন সরকারই তা করেনি।
মহান বিজয় দিবসে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আসুন আবারও আমরা শপথ নেই- আমরা যেন লাখো শহীদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাই। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই। যুবশক্তি, তরুণ সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ, তোমরা তোমাদের পূর্বসূরিদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনই ভুলে যেও না। তাঁদের উপহার দেয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না। যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নাও এই বিজয় দিবসে। প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের শেষাংশে বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলেন- ‘চাহি না জানতে- বাঁচিবে অথবা মরিবে তুমি এ পথে, এ পতাকা বয়ে চলিতে হইবে বিপুল ভবিষ্যতে’। সবাইকে আবারও মহান বিজয় দিবসের বর্ণিল শুভেচ্ছা। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকার রঙের নীল ও লাল রঙের শাল পরেছিলেন। তিনি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও চিরায়িত রূপ শস্য ক্ষেতের পাশে গ্রামীণ গাছ-পালার অপূর্ব মেলবন্ধনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন। ১৭ মিনিটের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশনে একযোগে প্রচার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ইসলামের জন্য যা করেছেন অন্য কেউ তা করেনি : দেশবাসীকে উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো তা কখনই করেনি। আইন করে মদ-জুয়া-ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন, ওআইসির সদস্যপদ অর্জনের মতো কাজগুলো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী-শক্তির মদদদাতা জিয়াউর রহমানের সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে বাংলার মানুষের এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে আমি দলের দায়িত্ব গ্রহণ করি। পিতার আদর্শকে ধারণ করে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর ব্রত নিয়ে কাজ শুরু করি। ১৯৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আসে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে এবং ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের সরকার দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করেছে।
ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রচারে তাঁর সরকারের বাস্তবায়িত বিভিন্ন পদক্ষেপের খণ্ডচিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ভাষণে বলেন, তাঁর সরকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার এবং প্রসারে যত কাজ করেছে, অতীতে কোন সরকারই তা করেনি। আমরা ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। ৮০টি মডেল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স মান দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছি।
তিনি বলেন, তাঁর সরকারের আমলে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের সহায়তার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় সারাদেশে মসজিদ-ভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষাধিক আলেম-ওলামায়ে কেরামের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তথাপি ১৯৭১’র পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানীং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
করোনা মোকাবেলায় বিশ্বে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোন এবং ১৫ আগস্টে শহীদ সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে আজ আমরা বিজয় দিবস-২০২০ উদযাপন করতে যাচ্ছি। এ বছর আমরা আমাদের মহান নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। কয়েকদিন পর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করব। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি।
তিনি বলেন, গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলা করে সমগ্র বিশ্বের বুকে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে দেশের দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে। পৃথিবীর বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে দেশ এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিককে আমি বিজয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী মহান বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী বিভিন্ন দেশ ও দেশের জনগণ, ব্যক্তি এবং সংগঠনের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বীর সদস্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাঁদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভারতের তৎকালীন সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণকে- যাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। এছাড়া করোনাভাইরাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে এ বছর যে সব রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, বরেণ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষ মারা গেছেন, আমি তাঁদের স্মরণ করছি। আমি সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ : করোনা মহামারী প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আরও বলেন, এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছর আমাদের বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে আমাদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, জনসমাগম এড়িয়ে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনই মহামূল্যবান। কোন অবহেলায় একজন মানুষেরও মৃত্যু কাম্য নয়। তাই আমি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় দিবস উদ্যাপনসহ যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করবেন এবং মাঝেমধ্যে হাত সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করবেন। আপনার সুরক্ষা, সকলের জন্য রক্ষাকবচ।
সরকারপ্রধান বলেন, এ বছরটি শুধু আমাদের জন্যই নয়, বিশ্ববাসীর জন্য এক দুর্যোগময় বছর। করোনাভাইরাসের মহামারী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনাভাইরাসের মহামারীর ফলে অনেক উন্নত এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে আমরা সময়োচিত পদক্ষেপ এবং কর্মসূচী গ্রহণ করে এই নেতিবাচক অভিঘাত কিছুটা হলেও সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি।
প্রবৃদ্ধিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ : করোনা মহামারীর সময়ে দেশের মানুষকে রক্ষা এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে তার সরকারের ২১ দফা প্রণোদনা ঘোষণার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, মহামারীর এই দুঃসময়ে তাঁর সরকার প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি প্রান্তিক মানুষকে নগদসহ নানা সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে আমাদের প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন এবং রফতানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ বলছে ২০২০ সালে বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলছে। আমাদের স্বপ্নের ও গর্বের পদ্মা সেতুর সব স্প্যান বসানো শেষ। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ আবার পুর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এই মহামারীতে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিদ্যুত কেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মহাসড়কগুলো চার-লেনে উন্নয়নের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছরের সংগ্রামের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ : বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের বিজয় অর্জনের প্রকৃত ইতিহাসও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে আমরা ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। এর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৬-এ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে। তারপর তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করে। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ষড়যন্ত্র করে।
এদেশের মানুষ জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা উদ্বৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন- বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বলেছিলেন ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে’- সেই নির্দেশকে শিরোধার্য করে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত অধিকাংশ বাঙালি সদস্য স্বাধীনতার পক্ষে প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হন। বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পেশাজীবীরাÑ সেদিন জীবনের মায়া ত্যাগ করে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দখলদার বাহিনী এবং তাঁদের এদেশীয় দোসর-রাজাকার-আলবদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে; হাজার হাজার নারীর সম্ভ্রমহানি করে, এক কোটি মানুষকে দেশ ছাড়া করে; আরও ৩ কোটি মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন, হানাদাররা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে কোটি কোটি বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। কিন্তু বাঙালি জাতি মাথানত করেনি। অত্যাচার-নিপীড়ন যত বেড়েছে, বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ততই মরিয়া হয়ে শত্রু বাহিনীর ওপর প্রতি-আক্রমণ শানিয়েছে। অবশেষে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাঙালি অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। বাংলাদেশ হয় শত্রুমুক্ত।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশের অভ্যুদয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত, দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখনই পরাজিত শক্তির দোসররা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তি মুজিবের মহাপ্রয়াণ হয়নি। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল, তা স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে একটি আদর্শ ও স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটানো হয়। যে স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন এ দেশের লক্ষ-কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।
ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না : প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে আরও বলেন, জাতির পিতা শুধু একজন খাঁটি মুসলমানই ছিলেন না, তিনি ধর্মীয় আচারাদি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন। তাঁর মতো আর কে বাংলার মানুষের মন-মনন-আকাক্সক্ষা বুঝতে পারত! তাই তিনি যখন সংবিধান রচনা করেন, তখন মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মৌলিক বিষয়কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, দুঃখের বিষয় ’৭৫-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের আসন চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ করে। সামরিক জান্তা সঙ্গীনের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।
ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানীং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। তাই ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না।
বাংলাদেশ কারও দয়ার ওপর নির্ভরশীল নয় : তাঁর সরকারের আমলে সবদিক থেকে থেকে দেশ এগিয়ে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা উদ্যাপন করছি। যদিও করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। করোনাভাইরাসের এই মহামারী না থাকলে আমরা যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করবো, ইনশাআল্লাহ। একইসঙ্গে চলবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বলতেন ভিক্ষুক জাতিকে কেউ সম্মান করে না। আমরা বাংলাদেশের সেই দুর্নাম ঘুচিয়েছি। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। আজকের বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। একটা সময় ছিল আমাদের উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আসত বিদেশী অনুদান থেকে। আজ বাজেটের ৯৭ ভাগ মেটানো হয় নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ কারও দয়া বা করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আমরা তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তাই আসুন, আবারও আমরা শপথ নেই- আমরা যেন লাখো শহীদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাই। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই।