কাজিরবাজার ডেস্ক :
এক সময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছিল না কোন শৃঙ্খলা। শিক্ষাবর্ষের কবে ক্লাস শুরু হবে, কবে থেকে পাবলিক পরীক্ষা শুরু হবে তার নির্ধারিত কোন সময় ছিল না। পরীক্ষা হলেও কতদিনে ফল প্রকাশ তারও ছিল না কোন দিনক্ষণ। এমন অবস্থার মধ্য থেকেই দীর্ঘ এক যুগের প্রচেষ্টায় পুরো ‘শিক্ষা ক্যালেন্ডারে’ ফিরিয়ে আনা হয়েছিল শৃঙ্খলা। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ক্যালেন্ডারে শৃঙ্খলা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শিক্ষায় সেশনজটও চলে এসেছিল সহনীয় মাত্রায়। তবে এবার করোনার ছোবলে আট মাস ধরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখন ওলটপালট পুরো শিক্ষা ক্যালেন্ডার।
শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তাও করা যাচ্ছে না। ক্ষতি কিছুটা পুুষিয়ে নিতে হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান কম বেশি অনলাইনে ক্লাস নিলেও তাতে সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। কবে হবে স্বাভাবিক ক্লাস, পরীক্ষা, কিংবা কবে কিভাবে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা? এমন উদ্বেগজনক প্রশ্ন এখন সামনে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকে একটি বছর হারিয়ে যাবে কিনা, তা নিয়েও এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের পরীক্ষা ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও শিক্ষা ক্যালেন্ডার অনুসারে নির্দিষ্ট সময় নেয়া যাবে কিনা সেই প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীর পরবর্তী শ্রেণীতে এবার উন্নীত করার ঘোষণার মধ্যেই উদ্বেগ আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুতেও কি সব কিছু স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে?
একদিকে বাস্তবতার কারণে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যেমন এখনও পরীক্ষা শুরু ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তাও করতে পারছে না, তেমনি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন টানা বন্ধের ঘটনা আর ঘটেনি। তবে করোনার কারণে শিক্ষার সঙ্কট এখন পৃথিবীজুড়েই। জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই বলেছে, এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ আগে কখনও হয়নি। এমনকি দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
করোনার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছিল চীন। বাংলাদেশে প্রথম দফায় গত ১৭-৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত দফায় দফায় বন্ধের মেয়াদ বাড়ছে। এর মধ্যে ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কোনমতে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা গেলেও উত্তীর্ণদের কলেজ ভর্তির সময় পিছিয়ে যায় বহুদূর।
সঙ্কট প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত হলেও বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে। কম বেশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, যদিও উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা শিশু। তার ওপর এই দুই স্তরে বাসায় থেকেও পড়াশোনা ঠিকমতো হওয়ার সুযোগ কম। অনলাইনে পাঠদানে বৈষম্যও আছে। শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ক্লাস ও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অনলাইনে।
শহর ও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। গত ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু টেলিভিশনের ক্লাস খুব কার্যকর হচ্ছে না। বলেই মনে করা হচ্ছে।
স্কুল বন্ধ করার আগ পর্যন্ত প্রাথমিকে মাত্র ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ বিষয়ভিত্তিক পাঠদান সম্ভব হয়েছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ইতোমধ্যেই সকল পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। বাতিল হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষাও। সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচীতে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে করোনার যে পরিস্থিতি, তাতে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া যাবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কর্মকর্তারা মনে করছেন, করোনার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এখন বিদ্যালয় খোলা ঠিক হবে না। তবে একাধিক সূত্র বলছে, দুই মন্ত্রণালয়ের একটি পরিকল্পনা হলো পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে দেখলেই কেবল প্রতিষ্ঠান খোলা হবে।
বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনই খোলার বিপক্ষে। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কোনভাবেই ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না।
বিদ্যালয় খোলার ক্ষেত্রে শুধু বিশেষজ্ঞ নয়, শিক্ষকদেরও মতামত নিতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা দরকার, যাতে আতঙ্ক দূর করা যায়।
এসএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। গত ১০/১২ বছর ধরে পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের রেওয়াজ তৈরি হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এক মাস বিলম্বে ৩১ মে এই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। বিলম্বে ফল প্রকাশ করা সম্ভব হলেও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হয় অন্তত সাত মাস।
এইচএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষার চিন্তাই শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয়েছে। বাস্তবতার কারণে বাধ্য হয়ে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের এ পরীক্ষার পরিবর্তে পরীক্ষার্থীদের দশম ও অষ্টমের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নের ঘোষণা করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকাশ হবে সেই মূল্যায়নের ফল।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের রুটিন অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গত ৪ মে’র মধ্যে শেষ হওয়ার সূচী নির্ধারণ করা হয়েছিল। এদিকে এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এখন বলতে পারছে না তারা শেষ পর্যন্ত কতটুকু কি করতে পারবে।
করোনার আঘাত লেগেছে পাঠ্য বইয়েও। একদিকে করোনার কারণে কাজে ধীরগতি অন্যদিকে প্রকাশকদের একটি সিন্ডিকেটের তৎপরতায় নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রম নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে কয়েক বছর সক্রিয় হতে না পারলেও এবার সেই পুরনো কৌশলে বইয়ের সকল কাজ কব্জা করতে তৎপর হয়েছে একটি চক্র। তারা জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কমে দরপত্র জমা দিয়েছেন। এতে সরকারের টাকা সাশ্রয়ের আশা জাগলেও বইয়ের মান রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বইয়ে কাগজ ও ছাপা নিম্নমানের হতে পারে এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা। উদ্বিগ্ন অনেক প্রকাশকরাও।
তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা আশ্বস্ত করে বলেছেন, বইয়ের মান রক্ষায় সরকার কোন আপোস করবে না। এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে নতুন বছরে পাঠ্যবই উৎসব হচ্ছে না। তবে বিকল্প উপায়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পৌঁছে দেয়া হবে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, বই তৈরি থাকবে। তবে যেভাবে বই উৎসব করি, যেখানে সব শিক্ষার্থী হাজির থাকে, এবার স্বাভাবিক কারণে, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে নিশ্চয় আমরা সমাবেশ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারব না। উৎসব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেই উৎসব করতে গিয়ে বড় একটা স্বাস্থ্যঝুঁকি আমরা নিয়ে নেব, সেটি বোধহয় সঠিক হবে না। বিকল্প কীভাবে করতে পারি সেটি আমরা জানিয়ে দেব।
মহামারীতে নতুন করে সেশনজটের আশঙ্কা এখন দেশের উচ্চ শিক্ষাস্তরের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সামনে। হাতেগোনা কিছু পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে কম বেশি ক্লাস নিলেও তাতে সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। অনলাইনে ক্লাসের বাইরেই থেকে যাচ্ছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। সঙ্কট সমাধানের কার্যকরী পথও খুঁজে পাচ্ছে না তারা।
করোনা সঙ্কটে বন্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেশি সঙ্কটে পড়বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজের আড়াই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। এখনই বড় ধরনের সেশনজটে থাকা এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ তাই সবচেয়ে বেশি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল উচ্চ শিক্ষার সঙ্কট ও তার উত্তরণ নিয়ে এখনই বেশি উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শই দিয়েছেন। দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থানা বিষয়ের অন্যতম এ বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, হ্যাঁ বন্ধ যদি আরও অনেক বেশি হয়। যদি ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে সেশনজট কিছুটা তো হবেই। তবে প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষা ক্যালেন্ডার সমন্বয় করে বেশি বেশি ক্লাস ও বেশি সময়ে ক্লাস নিয়ে সমস্যা কাটানো সম্ভব হবে। আবার শুক্র ও শনিবারও তখন ক্লাস নেয়া যাবে। প্রয়োজনে পরীক্ষা একটু এগিয়ে এনে হলেও সঙ্কটের অনেকটাই সমাধান করা যাবে।
তবে সীমিত পরিসরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেন, আমরা চেষ্টা করে দেখব পরিস্থিতি যদি অনুকূলে হয়, আমরা সীমিত পরিসরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার চেষ্টা করতে পারি। তবে সব কিছুই নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতি কেমন হয় তা ওপর। আমরা দেখছি যে বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের এখানেও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আগামী বছর যারা এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা দেবে, তাদের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা খুবই সীমিত পরিসরে, স্বাস্থ্যঝুঁকি একেবারেই যাতে না থাকে এ রকম একটা ব্যবস্থা করে কী করা যায়, সেগুলো আমরা চিন্তাভাবনা করে দেখছি। যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয় তাহলে আমরা সে ধরনের সিদ্ধান্তে যাব।
মন্ত্রী আরও বলেছেন, এবার যাদের এইচএসসি দেয়ার কথা ছিল তারা কিন্তু পুরো সিলেবাস শেষ করে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু আগামী বছর যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেবে, তাদের পড়াশোনায় কিছুটা হলেও ব্যাঘাত হয়েছে। আট-নয় মাস ক্লাস করতে পারনি। তাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য সীমিত পরিসরে হলেও এখন থেকেই নির্ধারিত পরীক্ষার আগ পর্যন্ত যদি সময় দেয়া যায়, নির্ধারিত যে সিলেবাস, তা তারা হয়তো সম্পন্ন করতে পারবে। যদিও নানাভাবে ক্লাস করাচ্ছি। এরপরেও সীমিত পরিসরে হলেও তাদের ক্লাসরুমে নিয়ে এসে যেখানে যেখানে সমস্যা আছে তা দূর করতে চাই।
আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা আশা করি এসএসসি পরীক্ষা পেছাতে হবে না। যদি প্রয়োজন হয় পরিস্থিতির কারণে, তবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনা করে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখব। তবে চেষ্টা করব সময়মতো পরীক্ষা নেয়ার।