সংবাদ সম্মেলনে রায়হানের মা সালমা বেগম যা বললেন

21

স্টাফ রিপোর্টার :
রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, পুত্র হত্যার বিচারপ্রার্থী এক অসহায় মায়ের কথায় সাড়া দিয়ে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ায় আপনার সবার প্রতি জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমার ছেলে রারহান আহমদকে (৩৩) গত ১১ অক্টোবর রাতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারকীয় এই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি আপনারা গণমাধ্যম কর্মীরাই সবার আগে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। যা পুরো সিলেটসহ সমগ্র বাংলাদেশ, এমনকি বহির্বিশ্বেও বিবেকমান মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে। ফলে, দেশে বিদেশে সর্বস্তরের মানুষ রায়হান হত্যকারী খুনী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে আন্দোলনে নেমে এসেছেন। আমাদের এলাকা বৃহত্তর আখালিয়াবাসী গত ১২ অক্টোবর থেকে লাগাতার আন্দোলন করে আসছেন। ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল, মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। রায়হান হত্যকারী বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ জড়িত সকল পুলিশ সদস্যের গ্রেফতারের দাবীতে ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য রায়হান হত্যকান্ডে প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবর পুলিশী হেফাজত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। সন্দেহভাজন হত্যাকারী আরো ৮ পুলিশ সদস্য এখনো পুলিশী হেফাজতে থাকলেও এখনো তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছেনা। এ সব বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
জাতির বিবেক সাংবাদিক সমাজ, আপনারা জানেন, আমার ছেলে রায়হান আহমদ একজন ডাক্তারের চেম্বারের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতো। কে গত ১০ অক্টোবর দিবাগত রাতের কোন এক সময় তাকে আটক করে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। পরে তাকে কয়টি সিএনজি অটোরিক্সাযোগে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আমার নিজের মোবাইলে একটি কল আসে। কল রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে আমার ছেলে রায়হান আর্তনাদ করে বলে, ‘আমাকে বাঁচাও। কিছু টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো। ফোন পেয়ে রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পৌছান। ফাঁড়ির পুলিশের কাছে রায়হানের অবস্থান জানতে চান হাবিবুল্লাহ চৌধুরী। পুলিশ জানায়, রায়হান ঘুমিয়ে আছে এবং তাকে যারা ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে, তারাও চলে গেছে। কর্তব্যরত পুলিশ হাবিবুল্লাহ চৌধুরীকে সকাল সাড়ে ৯টার সময় ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসতে বলে। কথামতো সকাল পৌনে ১০টার দিকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে হাবিবুল্লাহ চৌধুরী বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পৌছালে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জানায়, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী দ্রুত ওসমানী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন, সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে রায়হানকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে রায়হান মারা যান। খবর পেয়ে আমিসহ আমাদের আত্মীয় স্বজন ওসমানী হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে আমার ছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পাই। এ ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যদের আসামী করে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন, যা পরবর্তীতে মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয় কোতয়ালী জি. আর মামলা নং- ৪২৩/২০২০ ইং)।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ঘটনার পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবরসহ হত্যকান্ডে জড়িত অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা আমার ছেলেকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের স্বজনরা ওসমানী হাসপাতালে থাকা আমায় ছেলের মৃতদেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানালে গণমাধ্যম কর্মীরা অনুসন্ধানে নামে।
গণমাধ্যম কর্মদের অনুসন্ধানেই জানা যায়, ১১ অক্টোবর রাতে আমার ছেলে রায়হানকে আটক করে বন্দরবাজার পুলিশ ফাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানতে পারি, বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তাকে আটকে রেখে রাতভর নির্মম নির্যাতন করা হয়। রাতেই বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাব ইন্সপেষ্টর তৌহিদ এলাহীর মোবাইল ফোন থেকে আমাকে কল করে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবার হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে আমার ছেলেকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। রায়হানের দুই হাতের কব্জি ও পায়ের হাড় আঘাতের পর আঘাতে ভেঙ্গে দেয়া হয়। তার হাতের আঙ্গুললের নখ প্লায়ার্স দিয়ে টেনে তুলে ফেলা হয়।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, আপনাদের মাধ্যমে এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর পুরো সিলেটবাসী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে রায়হানকে হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও শান্তির দাবীতে বৃহত্তর আখালিয়াসহ পুরো সিলেটের মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। ফলে, বাধ্য হয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষ বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবরসহ ও পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করেন এবং আরো ৩ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করেন। নির্মম এই হত্যকান্ডের ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে গড়িমশি করেন। পরে, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর)-এর লিখিত নির্দেশের পর থানা কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে বাধ্য হন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত: পুলিশের এই চিঠি চালাচালির পর্যায়েই মূল আসামী, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পুলিশ এখনো তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মামলার তদন্তভার ইতোমধ্যে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই)-এর নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতোমধ্যে রায়হানের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, ওসমানী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, গুরুতর আঘাতের কারণেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। কিন্ত, রায়হান হত্যকারী পুলিশ সদস্যদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। ফলে, রায়হান হত্যা মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা নিহত রায়হানের পরিবার ও বৃহত্তর আখালিয়া এলাকাবাসীর পক্ষ ৬টি দাবী উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিশেষে এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে আমার বক্তব্য শুনার জন্য আপনাদেরকে জানাচ্ছি অশেষ কৃতজ্ঞতা।