অতিক্রম্য রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন শেখ হাসিনা

5

শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন তখন থেকেই শুরু আমাদের সক্রিয় রাজনৈতিক পথচলা। স্কুলছাত্র হিসেবে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে শোকাচ্ছন্ন শেখ হাসিনা যে চেতনার অগ্নিমশাল জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তাই লালন করছি গভীর আত্মপ্রত্যয়ে। ১৯৮১ সালের ২৯ মে বৃষ্টিস্নাত সেই দিনের বেদনাবিধূর আহ্বান আর হৃদয় ছোঁয়া ক্রন্দন মনোজগতে যে প্রভাব ফেলেছিল তা-ই পরিণত হয়েছে ধারাবাহিক রাজনৈতিক তৎপরতায়। শানিত হয়েছে গভীর জীবনবোধ আর রাজনৈতিক চেতনায়। তিনি যে চেতনার অগ্নিমশাল জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বেদনাবিধুর আহ্বান বহন করেছি রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায়। প্রিয় নেত্রীর নিবিড় পরিচর্যা আর স্নেহের প্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হওয়া সেই চেতনারই পরম্পরা।
কৃতজ্ঞতা প্রিয় নেতা। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৫ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ৭৩ বছর পেরুলেন। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাফল্যের শিখরে এখন তাঁর অবস্থান। পরিবার পরিজন হারিয়ে, ত্যাগ তীতিক্ষার পরীক্ষা দিয়ে সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য জীবন তাঁর। মাত্র ২৮ বছর বয়সে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পিতা-মাতা-ভাই পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। ঘটনাক্রমে দেশে না থাকায় ছোট বোন শেখ রেহানাসহ তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আকস্মিক সুনামির মতোই তিনি জন্মদাতা পিতা-মাতাকে হারিয়েছেন। বাংলাদেশ হারিয়েছে জাতি-রাষ্ট্রটির স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকেও হত্যা করা হয়। নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নসাধ ধ্বংস হয়ে যায়। উন্নয়নের স্বপ্ন যায় মিলিয়ে। সামরিকতন্ত্র স্থায়ী আসন গেরে বসে। বাংলাদেশে তখন ঘোর অমাবস্যা। এমনই এক পটভূমিতে ১৯৮১ সালে তাঁর অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক বর্ষণমুখর দিনে দীর্ঘ নির্বাসন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে শিশুপুত্র-কন্যাকে ফেলে দেশের ডাকে, জাতির প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তিনি। ছুটে আসেন সিলেটে। হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ফরিয়াদ জানান মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। দূর থেকে অবলোকন করা সেই মুহূর্তগুলো নিজের মধ্যে যে রাজনৈতিক বোধের জন্ম দিয়েছিল তা মানসপটে জাগ্রত থাকবে আজীবন। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে জেগে ওঠার শিক্ষা ও সাহস তিনি জাগিয়ে যান। অগণিত রাজনৈতিক কর্মী নতুন আশা, নতুন দিশার সন্ধান পায়। সেই যে লক্ষ্য নির্ধারণ তারই সফল জীবনচরিত আজকের সফল প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত ও ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক একটি দেশকে উন্নয়নের পথে, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে একটি সমৃদ্ধিশালী শান্তিপূর্ণ জনপদে পরিণত করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শ এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা থেকে উৎসারিত হয়েছে শেখ হাসিনার দেশ-ভাবনা ও উন্নয়ন-দর্শন। জীবনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ঘাত-প্রতিঘাত এবং দেশের মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকেই শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করেছেন। জাতিকে দিয়েছেন রূপকল্প। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট নিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে দোদুল্যমান অবস্থান নিয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্যে স্থির। অবিচল আস্থায়, দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অর্থনৈতিক গতিশীলতা। মানুষের জীবন ও জীবিকাকে স্বাভাবিক রাখতে নির্ধারণ করেছেন সরকারের অগ্রাধিকার ও কর্মকৌশল। এসবেই শেখ হাসিনার অনন্যতা। ক্রমশ নিজেকে নিজেই অতিক্রম্য করার স্বাপ্নিক উচ্চাশা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পরিণত বয়সেও তারুণ্যের ভাবনায় যেমন উচ্ছ্বাসিত হন। দরিদ্র আর পীড়িতদের ভাবনায় যেমন বিমর্ষ হন। তেমনি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি নিশ্চিত করে সৃজনশীল টেকসই উন্নয়নে দেখান সমান উৎসাহ। উত্তরাধিকার সূত্রে জাতির পিতার মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আর সবকিছুকে নিজের মনে করে কর্তব্য স্থির করার যে দুর্লভ গুণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তা বহন করছেন। তারই সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ তাঁর চিন্তাপ্রসূত উন্নয়ন কর্মকান্ডে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ করে বদ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ সেই অগ্রসর চিন্তার প্রতিফলন।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই তিনি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারান্তরীণ করা হয়। তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।
১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্র“য়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২রা মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দী হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাঁকে লক্ষ্য করে ২ বার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়। শেখ হাসিনা পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো সনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১শে আগষ্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫‘শর বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।
রক্তাক্ত আগষ্টের হৃদয়বিদারক ক্ষত বুকে নিয়ে, স্বজন হারানো শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেছেন বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির কান্ডারী হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এতো ত্যাগ, এতো নির্যাতন আর কোনো নেতাকে সইতে হয়নি। একজন শেখ হাসিনা ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কাঠিয়ে হয়ে উঠেছেন আজ নির্ভরতার প্রতীক।
শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন দুই দশক। তাঁর নেতৃত্বে একুশ বছর পর বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মমর্যাদা আর স্বনির্ভর হওয়ার পথকে থামিয়ে দিতে আবারও ষড়যন্ত্র। আবারও বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে ৭১ ও ৭৫ এর ঘাতকরা যখন একাট্টা তখন একজন শেখ হাসিনাকেই বাংলাদেশকে টেনে তুলতে হয়েছে অন্ধকারের গহ্বর থেকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল সরকার প্রধান হিসেবে আজ তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। চারবারের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পেয়েছে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের কারণে। দৃপ্ত অঙ্গীকারে ছুটে চলেছেন বাংলাদেশের স্বপ্নসারথি হিসেবে। নির্মম আর নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে মোকাবিলা করে তাঁর অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। জননেত্রী থেকে এখন বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একজন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে মানবিক বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁরই নেতৃত্বে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কমছে দারিদ্র্যের হার। দেশকে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে তিনি ‘ভিশন-২০২১’ ও ‘ভিশন-২০৪১’ কর্মসূচি নিয়েছেন। গ্রহণ করেছেন ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে শেখ হাসিনার এসব যুগান্তকারী কর্মসূচি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরভাস্বর থাকবে।
বাঙালির স্বপ্নসারথি, টেকসই উন্নয়নের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সমকালীন বিশ্বের আলোচিত নাম। তাঁর দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা আর জীবনবোধ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে উন্নত বিশ্ব। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌরবের। সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।