কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার শপথ নিয়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নিজস্ব উদ্যোগেই ‘শুদ্ধাচার’ ও এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটি ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। এ ক্ষেত্রে আপনাদেরকেই এই শুদ্ধাচারের পরিকল্পনা করতে হবে এবং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে।’ এই পরিকল্পনা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁঁছাতে ও তা সফলভাবে কার্যকর করতে হবে। আর যারাই এটা করতে পারবে, তাদের পুরস্কৃত করা হবে। বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়/ বিভাগসমূহের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর এবং এপিএ ও শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে যুক্ত হন।
সমালোচনায় কান না দিয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কে কী বললো, কে কী লিখলো ওইদিকে কান দিলে কোনও কাজ করতে পারবেন না। নিজের ওপর বিশ্বাস থাকতে হবে, নিজের ওপর আস্থা থাকতে হবে। আপনি সঠিক কাজটি করছেন কিনা। আস্থাটা থাকলে কাজের ফল দেশবাসী পাবে। আর দুর্যোগ আসবে, দুর্যোগের জায়গাই বাংলাদেশ। কিন্তু সেই দুর্যোগ মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমি সব সময় যেটা বলি, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমরা বিজয়ী জাতি। কাজেই সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমাদের চলতে হবে।’
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কিছু নিয়ে সমালোচনা করে। কিন্তু আমি মনে করি তারা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং সেই সময় তাৎক্ষণিকভাবে যে কাজগুলো করার দরকার ছিল সেটা যথাযথভাবে করা হয়েছে বলেই কোভিড-১৯ আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্যোগ আসবে, দুর্যোগের জায়গাই বাংলাদেশ। কিন্তু সেই দুর্যোগ মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
করোনাকালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের অর্থনীতি যাতে কোনরকম বাধাগ্রস্ত না হয়, গতিশীল থাকে সেজন্য বিশাল প্রণোদনা দিয়েছি। আমরা যে প্রণোদনা প্যাকেজগুলো দেয়া শুরু করলাম এটা কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশ আমাদের আগে দিতে পারে নাই। আমরাই প্রথম কিন্তু দিলাম। সেজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সবাই কাজ করছে।
কৌতুকচ্ছলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সাধারণত কিছু দিতে গেলে হাত টেনে রাখে; কিপটামি করে। কিন্তু এবারে কিপটামি করে নাই। সবাইকে হাত খুলে যেখানে যেটা দরকার আমরা দিয়ে দিয়েছি। সেভাবে দেয়া হয়েছে বলেই আজ আমাদের অর্থনীতির চাকাটা সচল থেকেছে। এ প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার ফলে আমাদের অর্থনীতির চাকাটা সচল থেকেছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ হিসেবে দিয়েছি। নগদ টাকা দিয়েছি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি দলীয়ভাবে বিভিন্ন সহায়তার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুজিববর্ষ আমরা পালন করব এই কর্মসূচী নিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা যেভাবে করতে চেয়েছিলাম সেভাবে পারলাম না। কিন্তু সেই সঙ্গে সীমিত আকারে করলেও আমাদের লক্ষ্যটা হলো, আমরা আমাদের পার্টি থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা এক কোটি বৃক্ষরোপণ করব। আবার সরকারীভাবেও সিদ্ধান্ত দিয়েছি বৃক্ষরোপণের।
দেশের কোন মানুষ গৃহহারা থাকবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকটা গৃহহারা মানুষ ভূমিহীন মানুষদের গৃহনির্মাণ করে দেব। এ বিষয়ে অনুরোধ করব যারা একেবারে ভূমিহীন, গৃহহীন তাদের আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি মানুষও গৃহহীন, ভূমিহীন থাকবে না। সবাইকে আমরা অন্তত একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেব। এই ব্যবস্থাটা আমাদের করতে হবে। ঘরে ঘরে বিদ্যুত, আল্লাহর রহমতে সেটা আমরা এই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে পারব, এই বিশ্বাস আমার আছে।
তিনি বলেন, আমাদের সবসময় মাথায় রাখতে হবে যে, প্রত্যেকেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। অনেক ডাক্তার মারা গেছেন, নার্স মারা গেছেন, স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। তারা কিন্তু সবাই কাজ করেছেন। তাদের পাশাপাশি প্রশাসন, সশস্ত্রবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে জনগণকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে এক শ্রেণীর লোক থাকে, তাদের সমালোচনা করাই অভ্যাস। পান থেকে চুন খসলে অনেক কথা বলবে। কিন্তু নিজেরা কিছু করবে না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি তো বেসরকারী টেলিভিশন অনেক দিয়ে দিয়েছি। তারপর বিদ্যুত দিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। এরাই একসময় সমালোচনা করেছিল, এখন সেই ডিজিটাল বাংলাদেশেই আমাদের বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার তারা চালাতে থাকবে। সেটা বলুক। আমি মনে করি, আমরা সঠিক পথে আছি কিনা এটা নিজের আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। সবাই যখন কাজ করবেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করবেন।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনগণের পাশে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের পাশে থাকা। আর আমরা জনগণের ভোট নিয়ে এসেছি। আমরা ওয়াদাবদ্ধ মানুষের কাছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছি বলে তাদের পাশে থাকা আমাদেরও দায়িত্ব। আমরা জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবন্ধ। আর যারা সরকারী চাকরি করেন তারাও জনগণের সেবা করতে প্রতিশ্রুতিবন্ধ। আপনারা যারা চাকরি করেন, আপনাদের দীর্ঘসময়। আমাদের থেকে সময় অনেক বেশি পান আপনারা। আপনারাও কিন্তু জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ। আপনাদের জনসেবা করতে হবে। জনসেবাটা করাই হচ্ছে দায়িত্ব।’
’৭৫ পরবর্তী ঘটনাবলীর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য সব থেকে একটি কালো দিন। ঘাতকের দল বা তাদের সঙ্গে দোসর যারা ছিল বা নেপথ্যে যারা ছিল তারা সামনে বেরিয়ে এলো। জাতির পিতাকে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচার শুরু হয়েছিল, তাদের মুক্তি দেয়া হয়, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, খুনীদের বিদেশী দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।
ওই সময় বাংলাদেশে বিচারহীনতা, নিয়মনীতিহীনতা, স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজত্ব ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতা চায়নি তারা হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং তারপরে অপবাদ ছড়ানো, নানা কথা বলা। জাতির পিতার সম্পর্কে, আমাদের সম্পর্কে। এইভাবেই একটা দেশকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা। সেনা কর্মকর্তা হয়েও জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই থেকেই তো আমাদের সমস্ত সিস্টেমটা নষ্ট হলো।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। আমরা পেছনে ফিরবো না। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব এবং বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই গড়ে তুলব। এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আগামীতে যেন আরও বেশি পুরস্কার পেতে পারেন সেভাবেই আপনারা সবাই কাজ করবেন।
দফতরগুলোর সঙ্গে সরকারের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির সুফল যে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছেই যাবে, সে কথা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের যে সম্পদ, জনগণই যে তার মালিক, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সেই সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ে আপনাদেরকে শুদ্ধাচার বিষয়ে নিজস্ব একটা পরিকল্পনা নিতে হবে যে কীভাবে আপনারা কাজগুলো সম্পন্ন করবেন। আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে তার নিচের স্তর পর্যন্ত এই পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং তা যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। যারা এটা কার্যকর করতে পারবেন, তারাই পুরস্কৃত হবেন।
শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার কথাও অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ একটা ইজ্জতহীন দেশে পরিণত হয়েছিল। সব জায়গায় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চলত। যেটা আমার খুব কষ্ট হত।’ আওয়ামী লীগের নেতৃতে গত এক দশকে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা আবার শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে বলেও অনুষ্ঠানে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির ‘সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে’ জাতির পিতার আজীবন স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কেন্দ্রে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।