টেস্টে গাভাস্কারের চেয়ে এগিয়ে কোহলি———- দিলীপ বেঙ্গসরকার

10

স্পোর্টস ডেস্ক :
টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্বোধোনী ক্রিকেটার ভাবা হয় ভারতের সাবেক অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কারকে। তিনি সর্বাধিকসংখ্যক টেস্ট রান ও সেঞ্চুরি নিয়ে ক্রীড়াজীবন শেষ করেন। তবে গাভাস্কারের চেয়েও টেস্ট ক্রিকেটে পারদর্শীতার ক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে এগিয়ে রাখছেন ভারতের সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার দিলীপ বেঙ্গসরকর। লর্ডসের লর্ড খ্যাত বেঙ্গসরকার সাম্প্রতিককালে ভারতের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই দাবি করেন। এছাড়াও ভারতের বর্তমান দল, আইপিএল ও ভারতের আসন্ন অস্ট্রেলিয়া সফর নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রশ্ন: আইপিএলে প্রতিভা অণ্বেষণের জন্য বিখ্যাত আপনি। আপনার নজর এবার কোন তরুণ প্রতিভার দিকে?
দিলীপ বেঙ্গসরকার: বিশ্বপর্যায়ের মঞ্চ আইপিএল অনেকের কাছেই একটা বড় সুযোগ। এই মঞ্চটাকে কাজে লাগাতে হবে। ভারত ‘এ’ দল এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনেকে খেলবে আইপিএলে। যশস্বী জয়সওয়াল, সিএসকে-র ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, শুভমন গিলরা সকলেই ভাল। আর সেটা তুলে ধরার সুযোগ কেউ যেন না হারায়। কারণ, আইপিএলের মতো মঞ্চ আর রোজ রোজ মেলে না। আমি নিশ্চিত, নিজেদের প্রমাণ করার জন্য সকলেই উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়েছে।
প্রশ্ন: করোনাভাইরাসের প্রকোপে দীর্ঘদিন ব্যাট-বল থেকে দূরে ছিলেন ক্রিকেটাররা। ঘরবন্দি কয়েক মাসের পর ক্রিকেটারদের ছন্দে ফেরা কতটা কঠিন?
বেঙ্গসরকার: করোনার কারণে পাঁচ-ছয় মাস বাইশ গজে নামতে পারেনি ক্রিকেটাররা। ফলে কাজটা খুব কঠিন। মাঠে নেমে অনুশীলনের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। সেটা অত্যন্ত জরুরি। তা সে আপনি যতই ফিট হোন, যতই জিমে ঘাম ঝরান না কেনো। মাঠে নেমে লম্বা একটা ইনিংস খেলা বা কয়েক ওভার হাত ঘোরানো পুরোপুরি অন্য অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে ফিটনেসের ততটা সম্পর্ক নেই। আবার বলছি, ম্যাচ না খেলা আর ম্যাচ-প্র্যাকটিসে থাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। তাই মাঠে নেমে সময় কাটানো ক্রিকেটে খুব জরুরি।
প্রশ্ন: আইপিএলের পর বিরাট কোহলিরা যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই সফরের জন্য কাদের দিকে নির্বাচকদের লক্ষ্য থাকা উচিত?
বেঙ্গসরকার: অস্ট্রেলিয়ায় ভারত টেস্ট সিরিজ খেলবে। যা আইপিএলের থেকে একেবারেই আলাদা ফরম্যাট। টেস্টে সব সময়ই স্পেশালিস্টের প্রয়োজন পড়ে। উইকেটকিপার বা যে কোনও পজিশনেই দরকার হয় বিশেষজ্ঞের। পাঁচ দিন ধরে পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে কাজ-চালানো কাউকে দিয়ে চলে না। যেমন মেক-শিফট উইকেটকিপার দিয়ে টেস্টে হবে না। একটা খোঁচা মিস করলেই তো চড়া মাসুল দিতে হবে। যার দরুণ ম্যাচ হাত থেকে ছুটেও যেতে পারে। আমার মনে হয়, টেস্টের কাজটা বিশেষ। সেটা মাথায় রেখেই দল বেছে নেবেন নির্বাচকরা।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় কেমন খেলবে ভারত? আগের বার ব্র্যাডম্যানের দেশে ইতিহাস গড়ে ভারত টেস্ট সিরিজ জিতেছিল। এবার কিন্তু স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নাররা ফিরে এসেছেন দলে।
বেঙ্গসরকার: আশা করছি ভারত ভাল খেলবে এবং সিরিজ জিতবে। অস্ট্রেলিয়া অবশ্যই ভাল দল। বিশেষত, স্মিথ-ওয়ার্নাররা ফেরার পর। কাগজকলমে ভারত অবশ্যই তাদের চাইতে ভাল দল। নিজেদের ক্ষমতা অনুসারে খেলতে পারলে অস্ট্রেলিয়াকে হারাবে ভারত।
প্রশ্ন: ভারত শেষ বার টেস্টে খেলেছিল নিউজিল্যান্ডে। দুটো টেস্টেই হারতে হয়েছিল। কোহলির কথায় পেসারদের নিয়ে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। এবার অস্ট্রেলিয়ার গতিময় উইকেটের কথা মাথায় রেখে কি এক্সপ্রেস বোলার নেওয়ার উপর জোর দেওয়া উচিত?
বেঙ্গসরকার: এটা পুরোপুরিই নির্বাচকদের ব্যাপার। জানি না ওদের মনে কোন উপায়ান্তর রয়েছে। আমি তো এখন কারা নির্বাচক সেটাও জানি না!
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের স্পিন আক্রমণ কেমন হবে, সেটা নিয়েও তো ধোঁয়াশা আছে। একমাত্র স্পিনারে খেলা হলে কে খেলবেন? রবিচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাডেজা নাকি কুলদীপ যাদব?
বেঙ্গসরকার: আমি জানি না। সেটাই তো বলছি। নির্বাচকদের ভাবনার আন্দাজ মিলছে না। ওরা প্রচুর ম্যাচ দেখে। তাই সেটার উপর নির্ভর করেই দল গড়বে নিশ্চয়ই। তবে আবার বলছি, নির্বাচকদের কতটা ভিশন আছে, সেটাই আমার জানা নেই। তারা কতটা জানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, কতটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটাও অজানা। তবে ওরা যেহেতু গাঙ্গুলি অ্যান্ড কোম্পানির দ্বারা নিযুক্ত, তাই অবশ্যই এই কাজের জন্য ওরাই সঠিক লোক!
প্রশ্ন: অনেকেই মনে করেন শচীন টেন্ডুলকারের ১০০ সেঞ্চুরি বা মোট রানের রেকর্ড একমাত্র বিরাট কোহলিরই ভাঙার ক্ষমতা আছে। কিন্তু করোনা অতিমারি কি কোহালির পথ আরও দুর্গম করে দিল না? ক্যারিয়ার থেকে কার্যত একটা গোটা বছরই তো হারিয়ে গেল!
বেঙ্গসরকার: ভবিষ্যতে কী হবে তা বলতে পারছি না। বিরাট কোহলি, কত দূর যাবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। তবে এটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই যে ও অসাধারণ ক্রিকেটার! ও-ই এক নম্বর ব্যাটসম্যান। পাশে রাখতে হবে রোহিত শর্মাকেও। তার থেকে ভালো কিছু আশা করা যায়। সেই প্রত্যাশা কতটা পূর্ণ করতে পারবে জানি না। আমি শুধু আশা করব, কোহলি যেন দেশকে প্রচুর ম্যাচ জেতায়। এই কথাটা খুব জরুরি— দেশকে জেতানো। আর এটাই বিরাটের থেকে সকলের চাহিদা।
প্রশ্ন: সাদা বলের ক্রিকেটে হিটম্যান রোহিত কী করতে পারেন, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়াতেই প্রথম টেস্টে ওপেন করবেন রোহিত। অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেট কি রোহিতের ব্যাটিং স্টাইলের পক্ষে বেশি সহায়ক হবে? অন্তত নিউজিল্যান্ড বা ইংল্যান্ডের মতো তো নতুন বল অতটা সুইং করবে না।
বেঙ্গসরকার: রোহিত, বিরাটরা অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। ওরা অস্ট্রেলিয়ায় অনেক বার গিয়েছে। ওখানকার কন্ডিশনে লম্বা খেলেছে। জানে কোন শট কখন নিতে হবে। কোন শট নেওয়া উচিত হবে না বা কী ভাবে একটা ইনিংস গড়ে তুলতে হবে। তারা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। আশা করি খুব দ্রুতই মানিয়ে নেবে নিজেদের। অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে ওদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন: গত অর্ধশতাব্দীতে উইজডেন তাদের অনলাইন সমীক্ষায় ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়কে বেছে নিয়েছে। আপনার পছন্দ কে?
বেঙ্গসরকার: আমার পছন্দ শচীন। তবে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। আমার মতে অবশ্য দ্রাবিড় নয়, গত ৫০ বছরে ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান শচীন। আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান ও-ই। সচিনের পরেই বিরাট। তার পর সুনীল গাভাস্কার আর রাহুল দ্রাবিড়।
প্রশ্ন: আপনার মতে শচীনের পর কোহলি?
বেঙ্গসরকার: হ্যাঁ। তিনে গাভাস্কার আর চারে দ্রাবিড়।
প্রশ্ন: গাভাস্কারের চেয়েও টেস্ট ক্রিকেটে এগিয়ে থাকবেন বিরাট? কেন?
বেঙ্গসরকার: দেখুন, এক-দুই-তিন-চারের মধ্যে কিন্তু তফাত খুব বেশি নেই। যতই শুনতে এমন লাগুক। আবার বলছি, তাদের চার জনের মধ্যে বেশি তফাত নেই। শচীন অজগ্র ম্যাচ জিতিয়েছে। একই কথা খাটে বিরাটের ক্ষেত্রেও। তুলনা করলে গাভাস্কার আর দ্রাবিড়ের চেয়ে ম্যাচ জেতানোর মাপকাঠিতে শচীন-কোহলি অনেকটাই এগিয়ে। গাভাস্কার ছিল ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ফলে সব সময়ই নতুন বলের মোকাবিলা করতে হতো। দ্রাবিড় হল নাম্বার থ্রি ব্যাটসম্যান। ওপেনার আর তিন নম্বরের মধ্যে বিশেষ ফারাক থাকে না। শচীন -বিরাটরা হল ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বর।
উল্লেখ্য, লর্ডসে দিলীপ বেঙ্গসরকারের তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি এখনও সফরকারী ব্যাটসম্যান হিসেবে নজির। প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়ক একসময় ছিলেন নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যানও। একসময়ে ছিলেন বোর্ডের ট্যালেন্ট রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট উইংয়েরও চেয়ারম্যান। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কর্নেল’ খেলেছেন ১১৬ টেস্ট এবং ১২৯টি ওয়ান ডে। দুই ফরম্যাট মিলিয়ে রান ১০,০০০-এর বেশি। টেস্টে গড় ৪২.১৩। মোট ১৭টি শতরান। আরবসাগরের পার থেকে তিনি আনন্দবাজার ডিজিটালকে যে সাক্ষাৎকার দিলেন, তা মেজাজে সহবাগ-সুলভ ধুমধাড়াক্কার সঙ্গে তুলনীয়।