বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব

10

তাপস হালদার

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। সে লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা হঠাৎ করেই থেমে যায়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন দেখছিলেন তা বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্ব সভায় একটি উন্নয়নশীল মর্যদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।
শোকাবহ ১৫ আগষ্ট। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকান্ডের কালিমা বেদনা বিদূর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মানবতার শত্র“ উচ্ছৃঙ্খল কিছু ঘাতকের হাতে শহীদ হন বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা শুধু ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে নয়, হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার মূল চেতনাকে, পবিত্র সংবিধানকেও। বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা জানে না, ব্যক্তির মৃত্যু হলেও আদর্শের মৃত্যু নেই। আদর্শই ব্যক্তিকে অনাদিকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে। বঙ্গবন্ধু এ ভূখন্ডে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনো নেতা নন। তিনি যে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। এসব তিনি এমনিই হননি, কেউ এসে ডেকে নিয়ে দিয়ে দেননি। প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করে তিলে তিলে অর্জন করেছেন। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতৃত্ব দিয়ে পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ গঠন করে ধীরে ধীরে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন।
হাজার বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল। মহাসমুদ্রের মতো হৃদয় ও অসীম সাহসের অধিকারী শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে বাঙালিদের মুক্ত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও নতুন করে বাঙালিদের ওপর চেপে বসে পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়ন। সেজন্য বাঙালি মাথা উঁচু করে কখনো দাঁড়াতে পারেনি। নির্যাতিত নিষ্পেষিত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে শেখ মুজিবের সম্মোহনী শক্তি। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নয় মাসের মুক্তি সংগ্রামে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বিশ্বের কাছে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের নেতা। স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ট ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের উন্নতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হয়। এই সাফল্যটাই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মেনে নিতে পারছিল না। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রোধ করতেই বঙ্গবন্ধুসহ গোটা পরিবারকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা কখনই তাদের পরাজয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সেনাবাহিনীর কিছু চাকরিচ্যুত উচ্চাভিলাষী কয়েকজন সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছিল। স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামালসহ পুরো পরিবারকে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা আজকের সমৃদ্ধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় তারা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান।
বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসের ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক হত্যাকান্ডে তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নয়, বাঙালির স্বাধীনতার আদর্শকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে চেয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথা ইতিহাসও। স্বাধীনতার মূল চারটি স্তম্ভ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে ভূলণ্ঠিত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। বাংলাদেশকে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাক্ষী হতে হয়। রাজাকারদের গাড়িতে উঠে লাল সবুজের পতাকা। একদম উল্টো পথ চলতে শুরু করে বাংলাদেশ।
১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডটি শুধু একটি রাতের ঘটনা নয়, মাত্র কয়েকজন ঘাতকের কাজও নয়। নেপথ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশতাক ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করে ঘাতকদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে। ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে অধ্যাদেশটিকে সংবিধানে সংযুক্ত করে কলঙ্কিত করে জিয়াউর রহমান। ঘাতকদের পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি, গণহারে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসি, রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদান, নিজামীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধে চেতনাবিরোধী কাজ শুরু করা হয়। সে ধারা খালেদা জিয়াও বজায় রাখে। ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনে খুনিদের সংসদে নিয়ে পবিত্র সংসদকে কলঙ্কিত করে। এখানেই শেষ নয়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে যেদিন বাতিল করে সেদিন সংসদ থেকেও ওয়াক আউট করেছিল বিএনপি ও জামায়াত। আর খালেদা জিয়া তো ১৫ আগষ্ট ভুয়া জন্মদিনের উৎসব করে বিকৃত মানসিকতার চরিত্র জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে।
১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনার প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠন হয় যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ আইনবিদ ও এমপি স্যার টমাস উইলিয়ামের নেতৃত্বে কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মী অবরি রোজ। কমিশন বাংলাদেশে আসতে চাইলে জিয়াউর রহমান তাদের ভিসা দেয়নি। কমিশন বাংলাদেশে আসতে না পারলেও এই ঘৃণ্য ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরতে কমিশন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন আসামির মৃত্যুদন্ড দেন। তবে ২০০০ সালে হাইকোর্ট ১২ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ৩ জনকে বেকসুর খালাস দেন। নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করলেও বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে রায় কার্যকরে বাধা সৃষ্টি করে রাখে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিচাবের রায় কার্যকর করে। এখন পর্যন্ত ৬ জনের রায় কার্যকর হয়েছে। একজন মারা গেছে। বাকি ৫ জন এখনো বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে।
আমরা অনেকেই বলে থাকি, এই হত্যাকান্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। আসলে কি আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা যে অপরাধ করেছি, তা থেকে কী কখনো কলঙ্কমুক্ত হতে পারি? যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালির জাতি থাকবে ততদিনই আমাদের এই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে। পশ্চিম জার্মানির নোবেল বিজয়ী নেতা উইলি ব্রানডিট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বলেছিলেন, ‘বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। সে বিচারে কি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারি? ১২ জন আসামির মৃত্যুদন্ডের রায় হয়েছে। ১২ জন সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের পক্ষেই কী এত বড় ঘটনা ঘটানো সম্ভব? নেপথ্যের মাস্টার মাইন্ডদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেটা কারো কারো ক্ষেত্রে মরণোত্তর বিচার হলেও।
ইতিহাসের স্বার্থেই নির্মোহ নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। সেদিন কোথায় কাদের কাদের ষড়যন্ত্র ছিল সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। কিছু বিপদগামী সদস্যদের পক্ষে এত বড় ঘটনা ঘটানো কখনই সম্ভব নয়। সেদিন রাষ্ট্রের যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল, তাদের কোনোভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বেনিফিশিয়ারি হয়েছিল, কারা বিচার প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। সেসব ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার। এখন সময় এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের জন্য কমিশন গঠন করে সত্যকে জাতির সামনে তুলে ধরার। এটা সময়ের দাবি।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। সে লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা হঠাৎ করেই থেমে যায়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন দেখছিলেন তা বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার বলিষ্ট নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্ব সভায় একটি উন্নয়নশীল মর্যদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব। কেননা, তিনি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। যতদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তিনি শুধু একজন ব্যক্তিই নয়, এক মহান আদর্শের নাম। আদর্শের কোনো মৃত্যু নেই। হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।