কে.এম লিমন গোয়াইনঘাট থেকে :
উন্নতি প্রযুক্তির উৎকর্ষে অপার সম্ভাবনাময় এ দেশ যখন কৃষি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে এসেও ক্রমাগত ভাবে পিছিয়ে পড়ছে গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের কয়েকেটি গ্রামের মানুষ। রবিশস্য থেকে শুরু করে বোরো ধান, প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢল আর আগাম বন্যায় তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায় তাদের জমির ফসল। গড়ে এক দশকে দুয়েকবার তারা ভালোভাবে তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারে কি না’ এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বছরের পর বছর চাষাবাদ করে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুণছেন এসব গ্রামের মানুষ। তাদের ফসল রক্ষায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ প্রকল্প নির্মাণ করা হলেও সেটির অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। ফলে এসব গ্রামের হাওর এলাকার জমিগুলোতে রবিশস্য ও বোরো ধান চাষাবাদে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
জানা যায়, উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের আসামপাড়া, আসামপাড়া হাওর, নবমখন্ড (আংশিক), সানকিভাঙ্গা, নয়াগাঙ্গেরপার ও বাউরবাগ হাওর (আংশিক) এলাকায় প্রায় ৯০০ হেক্টর ফসলি জমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমি নিচু এলাকায় হওয়াতে ওই জমিগুলোতে শুধু রবিশস্য ও বোরো ধান চাষাবাদ হয়ে থাকে। কিন্তু প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যায় এসব জমির ফসল তলিয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষকদের সহায়তায় এগিয়ে আসে জাপানিজ ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সি (জাইকা) নামের বিদেশি একটি সংস্থা। সংস্থাটি ২০১২ সালে আগাম বন্যার কবল থেকে এসব হাওর এলাকার ফসল রক্ষায় ৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটি বেড়িবাঁধ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে সংস্থাটি বেড়িবাঁধ প্রকল্পের আওতাধীন এলাকার জমিতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ ও অপসারণের স্বার্থে ৪ টি স্লুইসগেট নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা মোতাবেক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়।
বরাদ্দ অনুযায়ী গোয়াইনঘাট এলজিইডি অফিসের তদারকিতে স্থানীয় এলাকার কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত নলজুরি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড কর্তৃক ৫ হাজার ৮০০ মিটার বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
অন্যদিকে চারটি স্লুইসগেট নির্মাণের কাজ পায় সিলেটের এমএমআরজেবি কন্সট্রাকশন নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালে শুরুর পর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিন দফায় কাজের মেয়াদ বাড়িয়েও স্লুইসগেটের অ্যাপ্রোচের মাটি ভরাট না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তাদের দায়িত্ব শেষ করে।
পরে গোয়াইনঘাট এলজিইডি অফিস ও স্থানীয় সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজ অসম্পন্ন রেখেই ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকল্পটি হস্তান্তর করেন তারা। ফলে প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেয়ার কয়েক মাস পর ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পিয়াইন ও সারী নদী দিয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি স্লুইসগেটের দুইপাশের খোলা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে ওই এলাকার প্রায় ৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান ও রবিশস্য তলিয়ে যায়।
পরবর্তীতে আরও দুই দফায় বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলেও কাজের গুণগত মান ছিল দায়সারা গোছের। ফলে বিগত বছর গুলোর বন্যায় এবং পাহাড়ি ঢলে বেড়িবাঁধটির অনেক যায়গায় ভেঙে গেছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিন আগের বন্যায় বেড়িবাঁধটি এমন ভাবে ভেঙে গেছে যে, বর্তমানে প্রকল্পটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে। বেড়িবাঁধ বলতে এখন শুধুমাত্র চারটি স্লুইসগেটই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেস্তে যেতে বসেছে পাঁচ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ প্রকল্প।
তাই ওই এলাকার কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনা করে তাদের জমির ফসল রক্ষাশ বেড়িবাঁধটি পুনরায় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
এলজিইডি’র পাশাপাশি বেড়িবাঁধটির তদারকির দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় নলজুরি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংগঠন। এ ব্যাপারে কথা হলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আজির উদ্দিন সরকার বলেন, বেড়িবাঁধটির বিভিন্ন অংশে ভেঙে গিয়ে বর্তমানে প্রায় বিলীনের পথে। তাই অতি দ্রুত প্রকল্পটির সংস্কার কাজ না করলে এক সময় এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সুলতান আলী বলেন, যেহেতু অধিকাংশ সময়ে পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যায় ওই এলাকার রবিশস্য ও বোরো ধান তলিয়ে বিনষ্ট হয়। তাই কৃষকদেরকে লোকসানের কবল থেকে বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব বেড়িবাঁধটি মেরামত করা জরুরী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
গোয়াইনঘাট স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী রাসেন্দ্র চন্দ্র দেব জানান, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা এসে সরজমিন পরিদর্শন করে দেখে গেছেন। তবে আপাতত কোন বরাদ্ধ না থাকায় বেড়িবাঁধটির মেরামত কাজ করা যাচ্ছে না। বরাদ্দ পেলে প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছন।