কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ঝুঁকি আর শঙ্কার মধ্যেই খুলেছে সরকারী সকল অফিস, ব্যাংক, বীমা। জীবন ও জীবিকা রক্ষায় মানুষকে ‘স্বাভাবিক’ কর্মকান্ডে ফিরতে হচ্ছে নতুন বাস্তবতায় অভ্যস্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সীমিত পরিসরে চালু হচ্ছে গণপরিবহনের চাকাও। বাস-লঞ্চ-ট্রেন-বিমান চলবে। খুলেছে পুঁজিবাজার। ব্যাংকে লেনদেন আগের মতোই চলবে। সচল হচ্ছে দেশ। এখন সবাইকে বাইরে বের হতে হবে স্বাভাবিক সময়ের মতোই, কিন্তু সর্বক্ষণ সচেতন থাকতে হবে নিজে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে। দূরত্ব রক্ষা করে চলা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিকে করে নিতে হবে জীবনের সঙ্গী। প্রতিটি স্তরের কার্যক্রম চালাতে মানতে হবে সরকার নির্ধারিত স্বাস্থ্যবিধি। সরকারী-বেসরকারী অফিসের জন্য যেমন দেয়া হয়েছে ১৩ দফা গাইডলাইন তেমনি গণপরিবহসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চালু করতেও মানতে হবে শর্ত।
রবিবার থেকে খুলে দেয়া হয়েছে সব সরকারী অফিস। সারাদেশে ট্রেন ও লঞ্চ চলাচলও শুরু হয়েছে। ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাস চলাচল শুরু হচ্ছে আজ সোমবার থেকে। বিপণি বিতান আর দোকানপাট খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছিল রোজার মধ্যেই। তবে সরকারী-বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ এই মুহূর্তে খুলছে না।
গত ২৬ মার্চ থেকে চলা সাধারণ ছুটির মেয়াদ না বাড়িয়ে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস খোলার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। এই সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে জারিকৃত ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণের পাশাপাশি সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরে অফিসে আসতে বলা হয়েছে। তবে বয়স্ক, অসুস্থ ও সন্তান সম্ভবাদের এ সময় অফিসে আসা মানা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগে কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাই বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় সবাই অফিসে এসেছেন। আমিও অফিসের একটা কাজে মন্ত্রণালয়ে আছি। কাজ শেষ করে অফিসে চলে যাব।
জরুরী খাত হিসেবে ব্যাংকগুলো আগে থেকেই সীমিত পরিসরে খোলা ছিল। রবিবার থেকে আগের সূচীতে পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘আমরা ব্যাংকাররা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছি। এ কারণে ব্যাংকে আসতে ভয় লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। সরকারী নির্দেশ তো মানতেই হবে।’
বিআরটিসি ছাড়া অন্য বাস বা মিনিবাস রবিবার না নামলেও সকালে মিরপুর, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, তেজগাঁও এলাকা ঘুরে সড়কে প্রচুর যানবাহন চলতে দেখা গেছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ পরে সড়কে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সড়কের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের যেসব চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল, সেগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের ভিড় দেখা গেছে।
রবিবার সকালে ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক দীনেশ কুমার সাহা। তিনি বলেন, সকাল পৌনে ৭টায় সোনারতরী-৪ নামে একটি লঞ্চ চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। ‘অন্যসময় প্রতিদিন প্রায় আশিটি লঞ্চ সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যায়। আজও যাবে। তবে যাত্রীদের ভিড় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম।’
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল আলম বলেন, ঘোষণা অনুযায়ী রবিবার থেকে ট্রেন শিডিউল অনুযায়ী চলাচল শুরু করেছে। ট্রেনগুলো ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করেছে।
আপাতত চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, সিলেট-ঢাকা-সিলেট রুটে কালনী এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, উদয়ন/পাহাড়িকা এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস চলাচল শুরু হয়েছে।
কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম জানান, আপাতত কেবল আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। সেজন্য অনলাইনে টিকেট বিক্রি হচ্ছে শনিবার থেকে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে কাউন্টার থেকে কোন টিকেট দেয়া হবে না। যাত্রীদের কেউ অনলাইনে টিকেট নেয়ার পর প্রিন্ট চাইলে তাদের জন্য একটা কাউন্টার খোলা হবে।
করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার রোধে ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর রবিবার থেকে আবার চালু হচ্ছে সব। ছুটির পর রবিবার প্রথম কর্মদিবসের সকালে ঢাকার বিজয় সরণিতে দেখা গেল পুরনো সেই ভিড়। সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেনে চড়তে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস ছাড়া উঠতে দেয়া হবে না। ট্রেনে ওঠার আগে স্ক্যানার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা হবে। এছাড়া ট্রেনের প্রতিটি কামরা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করেছি।
সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর সব সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগও পুরো সময় চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগ খোলা থাকবে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে সতর্কতা হিসেবে গত ৪ এপ্রিল সব সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সীমিত পরিসরে চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। অফিস আদালত চালু হওয়ার পর সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশনা এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে। বাইরে চলাচলের সময় মুখে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনী ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। লকডাউন শেষে অফিস খোলার আগের দিন শনিবার অধিদফতরের এক আদেশে ‘অতি জরুরী প্রয়োজন’ ছাড়া রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে।
২ মাস পর কর্মচঞ্চল সচিবালয় : করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দুই মাসেরও বেশি সময় সাধারণ ছুটির পর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে সচিবালয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে রবিবার সকাল থেকে অফিস শুরু করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
মার্চ মাসের প্রথমার্ধে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হলে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী টানা ৬৬ দিনের ছুটি গতকাল শনিবার শেষ হয়েছে।
বিভিন্ন শর্ত পালন ও নির্দেশনা মানা সাপেক্ষে রবিবার থেকে অফিস খুলে দিয়েছে সরকার। তবে উপস্থিতি কিছুটা কম।
রবিবার সকাল থেকেই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয়ে আসতে থাকেন। কর্মচারীরা আগের মতোই স্টাফ বাসে সচিবালয়ে আসেন। দর্শনার্থী গেট দিয়ে তাপমাত্রা মেপে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সচিবালয়ে প্রবেশ করানো হয়। সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মাস্ক পরতে দেখা গেছে। অনেকে গ্লাভস পরে অফিসে এসেছেন। অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন। সচিবালয়ে দর্শনার্থী পাস দেয়া আপাতত বন্ধ রয়েছে বলে সচিবালয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অফিস খোলা উপলক্ষে প্রায় সবগুলো ভবনের মেঝেতে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ফ্লোরে-ফ্লোরে বিভিন্ন স্থানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে। বসানো হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। চার নম্বর ভবনের চতুর্থ তলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও জীবাণুনাশক টানেল বসানো হয়েছে। সচিবালয়ে গাড়ি রাখার স্থানগুলো আগের মতোই গাড়িতে পূর্ণ রয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় অন্যদের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে করোনা আতঙ্ক রয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশনা মেনে অফিস করতে এসেছেন। তবে খুব ভয়ে আছেন তারা। অফিস করার কারণে তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেল।
সচিবালয়ে চার নম্বর ভবনে বসেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অফিস বন্ধ হওয়ার পর বলতে গেলে বাইরে বেরই হইনি। অফিস খোলায় এখন আবার বাইরে বের হতে হলো। চাকরি করতে হলে তো অফিসে আসতে হবে। সচেতন আছি তারপরেও ভয় পাচ্ছি, কারণ অনেক স্থান ও মানুষের সংস্পর্শে আসতে হবে। তাই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছি।
দীর্ঘ ছুটির কারণে ইতোমধ্যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে স্থবিরতা নেমেছে। কষ্টে পড়েছেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও জীবিকা ও অর্থনৈতিক কারণে ছুটির পথ থেকে সরে এসেছে সরকার।