কমলগঞ্জের চার শতাধিক চাষী মধু চাষ, বছরে আয় অর্ধ কোটি টাকা

9

কমলগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়া পেশায় একজন মৌয়াল। বিভিন্ন পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতেন। বছর কয়েক আগে একদিন তিনি রাজকান্দি পাহাড় থেকে পাহাড়ী মধু সংগ্রহের সময় হঠাৎ ধরা পড়ে একটি রানী মৌমাছি। তিনি রানী মৌমাছিকে তার বাড়ি নিয়ে এসে একটি বাক্সে রেখে দেন। কয়েক দিন পর তিনি দেখেন যে বাক্সে হাজারো মৌমাছি জমা হয়ে এবং তারা সেখানে মধু আহরণ করেছে। তখন থেকেই তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথম মধু চাষের শুরু এবং ক্রমশ তা নেশায় ও পেশায় পরিণত হয়ে উঠে। বর্তমানে তাঁর ২০টি বাক্সে মধু চাষাবাদ চলছে। এই ২০টি বাক্স ছাড়াও পাহাড় থেকে মৌমাছি ও বিভিন্ন ব্যক্তির বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করে বছরে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় করেন। তার এই মধু চাষের বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্যরা মধু চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এভাবে ১ টি রানী মৌমাছি থেকেই শুরু হয়ে আজ আশেপাশের ৩০টি গ্রামের ৪ শত মধু চাষি বাণিজ্যিক ভাবে মধু চাষ করে কমলগঞ্জে এ শিল্পের নিরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন। সাত-আট বছর আগেও মধু চাষের বিষয়টি এই উপজেলার চাষিদের কেউ কল্পনাও করেননি, অথচ আজ তারাইা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের উৎপাদিত মধু বাজারজাত করে ১ বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আয় করেন। কোন ধরণের সরকারি আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই নিজেদের স্বল্প পুঁজি খাটিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা। তাদের এই অভবনীয় সাফল্যে এগিয়ে আসে বিসিক। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিসিক) মৌলভীবাজার ধরে মধু চাষিদের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মধু আহরণ ও সংরক্ষরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামে প্রথম মধু চাষের সূচনা হলেও বর্তমানে আদমপুর ও পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগ কালারায়বিল, ছয়ঘরি, কাঠালকান্দি, কোনাগাঁও, কানাইদেশী, রাজকান্দি, আধকানি, পুরানবাড়ি, নয়াপত্তন, কমলগঞ্জ পৌরসভার শ্রীনাথপুর, আলেপুর, কামারগাঁও ও ভানুগাছ এলাকার প্রায় ৩৫টি গ্রামের ৪ শতাধিক চাষি মধু চাষে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছেন। এখানকার চাষিদের উৎপাদিত এসব মধু মৌলবীবাজার, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমন কি প্রবাসীরাও মধু কিনে বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজ মধু, দাশকুলি মধু, মাছি মধু, ঘামি মধু ও মধু মালতি এই পাঁচ জাতের মধুর চাষাবাদ হলেও এ উপজেলায় মধুর চাষবাদ হয় দাশকুলি মধুর বাক্স (এ্যাপিস সেরেনা) স্থাপনের মাধ্যমে। প্রতিটি বাড়িতে ২-৫টি করে মধু উৎপাদনকারী কাঠের বাক্স স্থাপন করা আছে। এসব বাক্স থেকে বছরে তিন থেকে চারবার মধু সংগ্রহ করেন চাষিরা। স্বল্প খরচে এক একটি বাক্স থেকে ২৫-৩০ কেজি আহরণ করা হয়। বছরে সংগৃহীত মধু বিক্রি করে চাষিরা জনপ্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা আয় করছেন। সে হিসাবে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কেজি মধু উৎপাদন করছেন তারা। যার বাজার মূল্য প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। আর এই মধু চাষের কারণে তাদের ঘরে ঘরে এখন আর অভাব-অনটন নেই। প্রতিটি পরিবারে ফিরে এসেছে স্বচছলতা। প্রথমে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজেদের প্রচেষ্টায় মধু চাষে প্রত্যেকেই সাফল্যের মুখ দেখায় এসব গ্রামের নারীও এখন নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছেন এতে। তারাও এখন ব্যস্ত দিন কাটান। শুধু তাই নয়, নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে তারা গড়ে তুলেছেন ‘কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষী উন্নয়ন সমিতি’ নামে একটি সংগঠন।
আলাপকালে উপজেলার প্রথম মধু চাষি কাঁঠালকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়ার সাথে আলাপচারিতায় জানা গেলো মধুচাষের নানা অজানা কথা। তার মতে, মধু চাষাবাদের চেয়ে উন্নতমানের আর কোনো চাষাবাদ নেই। অল্প খরচেই লাখ লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব। মধু চাষাবাদের শুরুতে শুধুমাত্র একটি বাক্সে মৌমাছি সংগ্রহে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ ব্যতীত আর কোনো খরচ নেই। এক একটি বাক্সে বছরে চার বারে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। বাজারে প্রতি কেজি মধুর দাম ১ হাজার টাকা হিসাবে বছরে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এমন লাভের আশায় গত ৫ বছরে মধুচাষির সংখ্যা বেড়েছে। আশানুরূপ মধু উৎপাদিত হওয়ায় ক্রমশ বাড়ছে মৌমাছি চাষের পরিধি।
আলাপকালে কমলগঞ্জ উপজেলা সদরের আলেপুর পৌর এলাকার চাষি মোঃ আব্দুস সামাদ চৌধুরী, আহমদ সিরাজ, মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানসহ অনেকেই বলেন, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় তারা মধু চাষ করছেন। চাষিদের আরও উন্নত প্রশিক্ষণ ও তাদের উৎপাদিত মধু সরকারি উদ্যোগে বাজারজাতকরনে ব্যবস্থা হলে আরও অধিক উৎপাদন সম্ভব হতো এবং তেমনি চাষীরাও তাদের উৎপাদিত মধুর বাজারমূল্য আরও বেশি পেতেন।
কমলগঞ্জে মধুচাষি উন্নয়ন সমিতির সভাপতি শিক্ষক আলতাফ মাহমুদ বাবুল বলেন, এলাকায় মধু চাষের এমন নিরব বিপ্লব ঘটছে। বর্তমানে বিসিক ও কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছেন মধুচাষিরা। এই এলাকায় মধু চাষের একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারীভাবে পুঁজির ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ও সরিষার চাষাবাদ বৃদ্ধি করা হলে মধু চাষে আরো বিপ্লব হবে। কমলগঞ্জের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি, গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে এই এলাকা মধু চাষের চিহ্নিত জোন হিসাবে গড়ে তোলা যাবে। বিশেষতঃ আদমপুর, ইসলামপুর ইউনিয়নে মধু চাষে একটা ব্র্যান্ড তৈরি হতে পারে। এখানে একটি স্থায়ী মধু চাষ উন্নয়নে বিসিক বা সরকারের উদ্যোগে স্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশেকুল হক জানান, মধু চাষিদের বিসিকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারা মধু চাষ করতে পারছে।