বাবরুল হাসান বাবলু তাহিরপুর থেকে :
তাহিরপুরে হারিয়ে গেছে ’ভাগালু’-’দাওয়াল’ । হাওরাঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে ঘুরেও এখন দেখা মিলবে না তাদের। এক সময় চৈত্র-বৈশাখ মাসে হাওরে-হাওরে দেখা মিলতো ’ভাগাল’ু-’দাওয়ালে’র। এখন ’ভাগাল’ু নেই ,’দাওয়াল’ও নেই, আছে স্থানীয় শ্রমিক তারাই ধান কাটছে হাওরের।
হাওর পারের প্রবীনদের সূত্রে জানা যায়,সত্তরের দশকে দিকে তাহিরপুর উপজেলা সহ আশ পাশের উপজেলার শনি,মাটিয়ান,হালি, মহালিয়া সহ বড় বড় হাওরে বোরো ধান কাটতে শ্রমিক আসতো ফরিদপুর, মাদারীপুর,পাবনা,নরসিংদী জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোর ধান কাটার সময় দিনমজুর হিসাবে অনেক লোক দল বেধে আসতো হাওরাঞ্চলে। আর ঐ সমস্ত এলাকা থেকে আসা লোকজন হাওরের ভেতর থেকে ধান কেটে মাথায় বোঝা নিয়ে মাড়াই খলা পর্যন্ত পৌঁছে দিত। ধান কাটতে নগদ টাকা পয়সা দিতে হতো না। ধান কাটা মাড়াই শেষে ধানের ভাগ নিতো পারিশ্রমিক হিসেবে। তা থেকেই হয়তো তাদের ’’ভাগালু” বলা হতো। অনেকে আবার তাদের ’দাওয়াল’ও বলতো।
ধান কাটবার মৌসুমে আসবার সময় ভাগালুরা বড় নৌকা নিয়ে আসতো। বৈশাখ মাস এলে নদীর ঘাটে-ঘাটে বড়-বড় নৌকা নোঙ্গর করা থাকতো। নব্বই দশক পর্যন্ত তাদের বেশ যোগাযোগ ছিল হাওরের সাথে। পরবর্তীতে হঠাৎ করে ’ভাগাল’ু শুন্য হয়ে যায় হাওরাঞ্চল। স্থানীয়দের ধারনা ঐ সব অঞ্চলে সাধারণ মানুষের আয়-রোজগারে সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দিন দিন তাঁদের ধান কাটতে আগ্রহ কমেছে.তাই তারা ধান কাটতে আর আসেন না। তাছাড়া নব্বই দশকের পর মাদারীপুর.ফরিদপুর এলাকায় নদী ভাঙ্গন কমে গেলে সেই সাথে এক ফসলি জমি তিন ফসলি এলাকতে রূপান্তরিত হলে জীবিকার জন্য তাদের ছোটাছুটি কমে যায়। পরবর্তীতে তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন হাওরে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া ও নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা উপজেলা থেকে কিছু লোক আসতো ধান কাটতে। ২০১০ সালের পর থেকে ওই সব এলাকার শ্রমিকরাও আসা বন্ধ করে দেয় হাওরে। ফলে হাওর পারের কৃষক বাধ্য হয়ে উপজেলার ভেতরের বিভিন্ন গ্রাম ও আশপাশের উপজেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিক সংগ্রহের চেষ্টা করে থাকেন । বর্তমানে স্থানীয় শ্রমিকরাই ধান কাটেন। তবে তারা ’ভাগাল’ুদের মতো ধানের ভাগে নয়। নগদ টাকায় জমির ধান কেটে দেন।
শনিবার সকালে শনির হাওরে ধান কাটার সময় কথা হয় উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের দীঘির পাড় গ্রামের ধান কাটা শ্রমিক মুখলেছ মিয়া ও কালন মিয়ার সাথে। তাদের কাছে ধান কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান,তারা নগদ টাকায় ধান কাটছেন। ভাগে আর এখন কেউ ধান কাটে না। অনেক জমিতে ধান কম হয়,সেক্ষেত্রে ভাগে তাদের পোষায় না বলেও জানান। এভাবেই দিনে দিনে কালের চক্রে হারিয়ে যায় ’ভাগালু’-’দাওয়াল। আর মাড়াই খলায় ধানের ভাগ বন্টও চোখে পড়েনা না ক্ষেতমালিক-শ্রমিকের।
মধ্য তাহিরপুর গ্রামের প্রবীন খেতমালিক শফিকুর রহমান। কথা হয় ’ভাগালু’- ’দাওয়াল’ নিয়ে। স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে তিনি বলেন, ৮০ সালের দিকে ফরিদপুর,মাদারীপুর থেকে অনেক শ্রমিক ধান কাটতে আসতো হাওরে। তারা কৃষকের ধান ভাগে কেটে দিতো বলেই তাদের ’ভাগালু’ বলা হতো। তাছাড়া হাওর পারের অনেক এলাকায় বৈশাখের ধান কাটা মাড়াইকে ’দাওয়াই’ বলা হয়,এ থেকে ধান কাটার শ্রমিকদের দাওয়াল বলা হয়ে থাকে। নব্বই দশকের পর থেকে ’ভাগাল’ু নেই ’দাওয়াল’ও নেই। প্রবীণদের গল্পে নবীনরা এখন ’ভাগাল’ু খুঁেজ বেড়ান। ধান কাটা শ্রমিকদের আঞ্চলিক প্রচলিত নাম ’ভাগালু’-’দাওয়াল’ তাই ঠাই নেই শব্দ দ’ুটির অভিধানের পাতায়।