দীর্ঘ দেড় মাস পর স্পেনের রাস্তা শিশু-কিশোরদের পদচারণায় মুখরিত

16

স্পেন থেকে সংবাদদাতা :
দীর্ঘ দেড় মাস পর রবিবার স্পেনের রাস্তা গুলো মুখরিত ছিল শিশু-কিশোরদের কোলাহল আর উচ্ছাসে। স্কুটার, সাইকেল, খেলনা বল আর মানুষের পদচারণায় পরিপূর্ণ ছিল দেশটির ব্যস্ততম রাস্তা, পার্ক, সমুদ্র সৈকতসহ খোলামেলা সকল স্থান গুলো। গত ১৫’ই মার্চ দেশটিতে লকডাউন ঘোষণা দেওয়ার পর গত রবিবার প্রথমবারের মত স্পেনের রাস্তাগুলি খানেকটা সময়ের জন্য দেখতে পায় তার চিরচেনা লোকসমাগম। যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা।
কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা অব্যাহত রেখে স্পেন সরকার গেল সাপ্তাহে ঘোষণা দেয় ২৬’ এপ্রিল রবিবার থেকে কমবয়সী শিশু-কিশোরদের স্বার্থে দেশটিতে লকডাউনে কিছুটা শিথিলতা থাকবে। এতে করে খানেকটা স্বস্তি আসে টানা ছয় সাপ্তাহ ধরে গৃহবন্দী থাকা স্পেনীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে। আর তাইতো রবিবার সকাল থেকেই মানুষ জনের পদচারণায় ব্যস্ত হতে শুরু করে দেশের প্রতিটা বসতিপূর্ণ অঞ্চলের রাস্তাঘাট আর ছোটবড় সব উদ্যান গুলো। এদৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল প্রকৃতি যেন দীর্ঘদিন পর নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশান্তির নিশ্বাস নিচ্ছে।
স্পেনের ১৪ বছরের কম বয়সের শিশুরা একটানা ৪৩ দিন ঘরে বন্ধী থাকার পর, আজ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলো। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, স্পেনের অনূর্ধ্ব ১৪ বছর বয়সী প্রায় ৬৩ লাখ শিশু এখন প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে। একেত্রে তাদের গন্তব্য হবে বাড়ির এক কিলোমিটারের গন্ডির মধ্যে, সঙ্গে থাকবে বাবা-মা কিংবা পরিবারের কোনো জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। আর একদলে তিন জনের বেশি হবে না।
করোনা মহামারির এই অচেনা সময়ে, এক মাসেরও অধিক কাল গৃহবন্ধী হয়ে থাকার এ ঘটনা, শিশুদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজ সারা স্পেনে প্রায় ৬০ লক্ষ শিশু এই বন্ধী পরিস্থিতি কাটিয়ে রাস্তায় নেমেছে, যদিও অনেক প্রদেশে বৃষ্টি ছিলো। অনেক শিশুদের আবেগে উচ্ছাসিত হয়ে রাস্তায় ছুটতে দেখা গেছে।
করোনা মহামারির কারণে তৈরি হওয়া সামাজিক দূরত্বের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে স্পেনের বার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা।
ধারণা করা হচ্ছে, মহামারি পরবর্তী পরস্থিতিতে এ ধরণের ব্যবসার ৪০ হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। যা শতকরা হিসেবে ১৫%। স্পেনে মোট ২ লক্ষ ১৯ হাজার বার রেস্টুরেন্ট আছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্পেন এই ব্যবসার শীর্ষে। কিন্তু করোনা মহামারি অকল্পনিয় সময়ের মধ্যে (তিন দিনের ভেতরে) সব ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে। এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কবে আবার খুলবে আর কিভাবে ব্যবসা পরিচালিত হবে? এখন সামাজিক দূরত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে এই ব্যবসার সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো চোখে অন্ধকার দেখছে।
আগামী ২ মে থেকে সংক্ষিপ্ত হাঁটা বা পায়চারি করার জন্য বড়রা (বয়স্কসহ) রাস্তায় বের হতে পারবে বলে নিশ্চিত করেছে সরকার। তবে এর মধ্যে যদি কোন ধরণের সংক্রমন বৃদ্ধির প্রাদুর্ভাব থাকে তাহলে সময় পরিবর্তন হতে পারে।
এদিন সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে ভাইরাল হতে থাকে একের পর এক ছবি আর ভিডিও ক্লিপ। যেখানে দেখা যায় শিশু কিশোর এবং তাদের সাথে আসা প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে বেশিরভাগ সতর্কতার অনুসরণ করে বাহিরে বের হয়েছেন। প্রায় সবাই গ্লাভস এবং স্যানিটারি মাস্ক পরেছিলেন। তারা তাদের বাড়ি থেকে সর্বাধিক এক ঘন্টা এবং এক কিলোমিটারেরও কম পথ অবধি চলেছেন। এ সময় বিভিন্ন শহরের অনেক বড় বড় রাস্তা গুলোতে যানজট সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল এমনটাও লক্ষ্য করা যায়। এর কারন হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবি এবং ভিডিও গুলো বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তাদের অনেকেই কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা সঠিক ভাবে অনুসরণ করেনি। নির্দেশনা অনুযায়ী একজন প্রাপ্ত বয়স্কের সাথে সর্বোচ্চ তিনজন নাবালক থাকার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও দেখা যায় পুরো পরিবার মিলে হাঁটাচলা করছেন, কখনও কখনও অন্য পরিবারের সাথে একসাথে কথা বলতে বা আড্ডায় মেতেছেন দেখা মেলে। তাছাড়া বাচ্চাদের মাঝেও দেখা যায় গেম এবং খেলনা সামগ্রী একে অন্যের সাথে ভাগ করে নিচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে রবিবার স্পেনের রাস্তাঘাট, পার্ক এবং উদ্যান গুলিতে মানুষের ভিড় যেনো দেশটিতে বছরের প্রথম বসন্তের ছবি ফুটিয়ে তোলেছিল। প্রকৃতি তার পরিচিত মুখগুলোকে ফিরে পেয়ে নিজেই যেন প্রফুল্লচিত্তে হেসে উঠেছিল।
অন্যদিকে স্পেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা রবিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এইদিন স্পেনের করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এপর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম দিন কেটেছে। এদিন স্পেনে মৃত্যুর সংখ্যা ২৮৮’তে নেমে এসেছিল, যা ২০ মার্চের পর থেকে বিগত ৩৭ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন সংখ্যা। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭২৯ জন, যা আশানুরূপ উন্নতির দিকে।
উল্লেখ্য গত রবিবার স্পেনে মৃতের সংখ্যা নেমে এসেছে ৩০০ এর নীচে। গত ৬ সপ্তাহ ধরে মহামারির প্রাদুর্ভাবে প্রতিনিয়ত আশার আলো হতাশার আঁধারে ফিকে হয়ে আসছিলো। ২৬ এপ্রিল থেকে যেনো, সেই বহুল প্রত্যাশার আলোর আভাস আবার ফুটে ওঠতে শুরু করেছে। গত ২১ মার্চের পরে সবচে কম মৃতের সংখ্যা এটি । সংখ্যাটি ৩০০এর নীচে নেমে এসেছে।
গত ২৬ এপ্রিল (২৪ ঘন্টা) স্পেনে মোট মৃতের সংখ্যা রেজিস্ট্রি করা হয়েছে ২৮৮জন। ২৫ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ছিলো ৩৭৮ জন, ২৪ এপ্রিল যেটি ছিলো ৩৬৭জন।
গত ২৬ এপ্রিল নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ১,৭২৯জন। নতুন আক্রান্তের তুলনায় সুস্থের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি । মোট সুস্থ হয়েছেন ২৬ এপ্রিল ৩,০২৪ জন।
২৬ এপ্রিল পর্যন্ত স্পেনে মোট মৃতের সংখ্যা ২৩ হাজার ১৯০ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৬২৯জন। সুস্থ হয়েছেন প্রায় ১ লক্ষের কাছাকাছি, মোট ৯৮হাজার ৭৩২জন।