বাংলাদেশের অসামান্য অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি সাফল্যের পালক – প্রধানমন্ত্রী

18
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মুজিব বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে পরিচ্ছন্ন গ্রাম-পরিচ্ছন্ন শহর কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বের আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নিজস্ব স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর এবার প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের যুগেও পদার্পণ করল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার খুলে দেয়া হলো ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত আন্তর্জাতিকমানের দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। বাংলাদেশের অসামান্য অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি সাফল্যের পালক। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার একধাপ পূরণ হলো। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে এই এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত হবে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পথ।
আনুষ্ঠানিকভাবে এই এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনকালে এটিকে জাতির জন্য মুজিববর্ষের অনন্য উপহার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু হলে তার সর্বোচ্চ সুবিধা যাতে দেশের মানুষ পায়, সেজন্য আধুনিক মহাসড়কের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রেখে এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সকল মানুষের যোগাযোগের নতুন দ্বার উšে§াচিত হলো।
বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এ ধরনের বড় বড় প্রকল্প আমাদের বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করবে, এ ধরনের আধুনিক সড়কপথ নির্মাণ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার চিত্রও পাল্টে যাবে। এখন থেকে খুব দ্রুত টুঙ্গিপাড়া যেতে পারব। এ মাসেই আমি টুঙ্গিপাড়া যাব। তখন এক্সপ্রেসওয়ে দেখা যাবে। পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমরা শুধু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ খ-নই করিনি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে যাচ্ছি। আমরা নিজেরা করতে পারি, এই একটা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সারাবিশ্বে সকলের কাছে একটা সম্মান পেয়েছে।
পদ্মা সেতুর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুটাও কিন্তু একটা ভিন্নধর্মী সেতু। দেশে এই প্রথম দোতলা সেতু নির্মাণ হচ্ছে। এই সেতুর নিচ দিয়ে ট্রেনলাইন থাকবে আর ওপর দিয়ে গাড়ি যাবে। পদ্মা নদীর মতো একটা খরগ্রোতা নদীতে কাজ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার এবং এর নির্মাণ কাজটা করা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করছি। আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারি; এ বিশ্বাস আমাদের আছে এবং তা প্রমাণ করে দেখানো হলো।
তিনি বলেন, শুধু সড়কপথ নয়, নৌপথ, রেল এবং সেই সঙ্গে আকাশপথÑ সব দিকেই আমাদের লক্ষ্য আছে। আমরা সমস্ত বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিচ্ছি, যা মানুষকে আরও উন্নয়নের সুযোগ দেবে, জীবনমান উন্নত করার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, যে কোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি ভাল হয় একটা দেশের বা অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জাপান গিয়েছিলেন, তখন তিনি যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কথা বলেন। জাপান সরকারকে এই সেতু নির্মাণ করার জন্য অনুরোধ করেন। জাপান সরকার এই সেতু ফিজিবিলিটি স্টাডি করে দেয়, যার ফলে আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করতে পেরেছি। সেই সূত্র ধরে তখন তাদের বলেছিলাম আমরা যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করেছি, এখন আমরা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করতে চাই। সে হিসেবে জাপান পদ্মা সেতুর ফিজিবিলিটি স্টাডি করে।
কিছুদিন পরই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়ে যাবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যে করতে পারি, পদ্মা সেতুর মতো একটা অবকাঠামোই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে দেবে। সারাবিশ্বে এই সেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের লোক যাতায়াত করতে পারবে। এছাড়া আমিও টুঙ্গিপাড়ায় যেতে পারব খুব দ্রুত। এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা সেতু দুটোই আমাদের নতুন চমক, এই এক্সপ্রেসওয়েতে কোন ট্রাফিক সিগনাল থাকবে না। একটানা গাড়ি চলে যেতে পারবে। আশপাশের এলাকার মানুষের জন্য দুই সাইডে আলাদা রোড করে দিয়েছি। তাদের আর হাইওয়েতে আসতে হবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহনগুলো ওই রাস্তায় চলাচল করতে পারবে। আমি নিজে গিয়ে এই রাস্তা উদ্বোধন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে গেলে অনেক উদ্বোধন পিছিয়ে পড়বে। তাছাড়া আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস করছি। আমরা বলেছিলাম এই বাংলাদেশ একদিন ডিজিটাল হবে। আজ সে কথা সত্য হয়েছে। ডিজিটালের মাধ্যমে আজ এই গণভবন থেকে সারাদেশে অনেক প্রকল্প আমরা উদ্বোধন করতে পারছি। এতে আমাদের সময় সাশ্রয় হচ্ছে।
সরকারে থেকে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করার সুযোগ দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাংলাদেশটাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ছিল। যখন তিনি এদেশ স্বাধীন করেন তখন এদেশের ৮২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। এমনও ছিল অনেক মানুষ যারা একবেলা খাবারও জোটাতে পারত না। পাশাপাশি ঘর নেই, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। রোগে চিকিৎসা পেত না। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে তখনকার অবস্থা যেমন জানা যায় এবং তিনি যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তিনি সবসময় চেয়েছিলেন, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন। আজকে আমাদের ওপর সেই দায়িত্ব পড়েছে। যেকোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি ভাল হয় একটা অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আমরা ছিলাম সব থেকে অবহেলিত। এই ভাঙ্গা পর্যন্ত যেতে হলে এক সময় স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হতো। আর গোপালগঞ্জ যেতে গেলে ২৪ ঘণ্টা লাগত স্টিমারে যেতে। লঞ্চ হলে আরও বেশি সময় লাগত। এমনকি ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আসি তখনও এই অবস্থা ছিল। আজকে আর সেদিন নেই। আমরা ’৯৬ সালে সরকারে আসার পর থেকে পুরো বাংলাদেশে কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা যায়, ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি। আর দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে এ পর্যন্ত সরকারে থেকে আমরা আমাদের পরিকল্পনা মাফিক সমগ্র বাংলাদেশে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা নদীর মতো একটা খর¯্রােতা নদীতে এ জাতীয় সেতু নির্মাণ করাÑ এটা একটা বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার এবং চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করছি। আমরা যে নিজস্ব অর্থায়নেও আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারি, এই আত্মবিশ^াসটা আমাদের আছে এবং তার ফলে আমরা এটা নির্মাণ করছি। তিনি বলেন, এখানে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হতে না হতেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাদের ওপর দোষারোপ করেছিল দুর্নীতির। আমি সেখানে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, এখানে দুর্নীতি হয়নি। আমাদের অনেকেই এখানে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে, এখানে দুর্নীতি হয়েছে। এটা নিয়ে মামলাও হয়। কানাডার কোর্টে যে মামলা হয়, সেখানেও প্রমাণিত হয় এখানে কোন দুর্নীতি হয়নি।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সমস্ত অভিযোগ, এটা ছিল বানোয়াট। কিন্তু এটা আমাদের জন্য একটা সম্মানের ব্যাপার ছিল। কারণ আমি, আমার ছোট বোন, আমাদের পরিবার। আমরা তো সব হারিয়েছি। বাবা-মা, ভাই সব হারিয়ে আমরা দুজন নিঃস্ব। আমাদের কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, উন্নত করা, জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা-এটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এই ধরনের একটা অভিযোগ যখন নিয়ে আসে, এটা আমাদেরকে চরমভাবে অসম্মান করা হয়েছিল। তাই এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি এবং আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি, তখন তারা সকলে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রসঙ্গ উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এই অভিযোগ শুধু খ-নই করিনি আজকে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ করে যাচ্ছি। শীঘ্রই এটা আমার মতে শেষ হবে। সেজন্য সকলের দোয়াও চাই। কারণ এটা ছিল আমাদের সব থেকে বড় একটা আত্মসস্মানের ব্যাপার। আজকে আমরা নিজেরা করতে পারি, এই একটা সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সারাবিশে^ সকলের কাছে একটা সম্মান পেয়েছে।
উদ্বোধন ঘোষণা শেষে প্রধানমন্ত্রী বরিশাল, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে সংযুক্ত হয়ে মতবিনিময় করেন। প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন শেষে দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মোঃ নজরুল ইসলাম প্রকল্প বিষয়ে তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন। রেলপথমন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পিএমও’র এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ, পিএমও সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রেস সচিব ইহসানুল করিমও অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।