ওবায়দুল মুন্সী
একটি ভাষণ ঐতিহাসিক
বিশ্বজুড়ে নামী
একটি ভাষণ মহাকাব্য
সাহিত্যে খুব দামী।
একটি ছবি মহাকবির
রাজনীতির এক রাজা
একটি ছবি বাংলাদেশের
ঘরে ঘরে সাজা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০১৯ সালের জুন মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাত-ই মার্চের ভাষণটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছে। পূর্বে ভাষণটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হলেও বিদেশি ভাষা হিসেবে জাপানি ভাষায় প্রথম অনুদিত হয়।
নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে প্রমাণ করে। আজ বঙ্গবন্ধুর ৭-ই মার্চের ভাষণ সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পেলো।
এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে তুলনা করেছেন। কারণ স্বাধীন দেশে দীর্ঘসময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।
২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ কিশোরগঞ্জ ছড়া উৎসবে, খ্যাতিমান ছড়াকার ও শিশু সাহিত্যিক, রফিকুল হক দাদু ভাই বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। ওই ভাষণ একদিকে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জাগিয়ে তুলেছিল, অপরদিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর ভিত। এটিই মূলত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। ৭ মার্চের ভাষণ আজ বাঙালি জাতির মুখে মুখে উচ্চারিত এক অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
শাবিপ্রবির শিক্ষক জাফর ইকবাল একদিন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু নয় বরং ইউনেস্কোই এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়েছে। কারণ এখন তাদের কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি আছে, এমনটা তারা বলতে পারবে। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা, জাতীয় রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ সচিবালয়ে একদিন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন৷। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল৷ তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি৷ তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷ প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না৷’
“২০১৫ সালে ক্যানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন৷ সেখানেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল৷ তখন একাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও এবার পেলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি৷
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ৩৫ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে, প্রামাণ্যচিত্রটির নাম হচ্ছে ‘সেই কণ্ঠস্বর’। যৌথভাবে প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনা করছেন প্রিয়াঙ্কা আচার্য ও ওয়ালিদ।
খান আখতার হোসেন পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ ‘দুরন্ত’ চলচ্চিত্রটি, বঙ্গবন্ধুর ভাষন নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ যেভাবে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে। তেমনি এই ভাষণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে উঠে এসেছে জাতির জনকের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ৷তবে, ৭ই মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতী নির্মাণ করেছেন, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘তর্জনী’।
২০১৯ খ্রিস্টাব্দ ৭ মার্চের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চের ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আমার মা। ওই দিন সকাল থেকে অনেক নেতা অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকে চিরকুট রেখে গেছেন। দুপুরে খাবারের পর মা আব্বাকে বললেন, আপনাকে একটু রেস্ট নিতে হবে। তখন আব্বাকে বেডরুমে নিয়ে গেলেন। ১৫ মিনিট রেস্ট নেন। সেসময় মা আব্বাকে বলেছিলেন, অনেকে কথা বলেছে। আজকে তুমি তোমার মন যা বলবে, তাই বলবা। কারণ তোমার এই ভাষণের ওপর বাঙালির ভাগ্য নির্ধারণ হবে। তুমি যা ভালো মনে করবে বলবে।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে-কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতেই ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়নি তখনকার পাকিস্তান সরকার। কিন্তু পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে। মঞ্চে উঠেই তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনিত হয়। বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাটÑ যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়, তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন। এতে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি নতুন প্রেরণা খুঁজে পায়। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এটাকে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনাও বলা হয়। এই ভাষণের পরই মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই একমাত্র ভাষণ যার মধ্য দিয়ে গোটা বাঙালি জাতি সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সন্দেহ-অবিশ্বাস ঝেড়ে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই হচ্ছে বিশ্বসেরা ভাষণ। এর আগে মানুষের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কারণ সংসদ অধিবেশন বসার প্রস্তুতি চলছে প্রথমে ৩ মার্চ, পরে ২৫ মার্চ। অন্যদিকে আবার নানা ধরনের সমঝোতা বৈঠক চলছে। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির বঞ্চনার কথা বলেছেন, রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বলেছেন, বাঙালির মুক্তির সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলেছেন, সর্বোপরি স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বস্তুত এটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তারপরও উল্লেখিত বাক্যগুলোয় সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে কী নেই যে, এটাকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলা যাবে না। সব বিজ্ঞ বিশ্লেষকই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণই হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক গুরুত্ব। বাঙালি জাতি যেন যুগ যুগ ধরে এ ভাষণের জন্য অপেক্ষা করেছে তাদের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। ইতোমধ্যে স্বাধীনতাকে ঘিরে অনেক সরকারি-বেসরকারি দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু ৭ মার্চ সেভাবে কোনো দিবস হিসেবে পালিত হয় না। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ৭ মার্চকে সরকারিভাবে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা প্রয়োজন বলে আমি মনেকরি। গবেষকরা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা। সংশ্লিষ্ট সব মহল বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন, এটাই হোক মুজিব বর্ষের প্রত্যাশা। পরিশেষে, আবারও ছান্দসিক ছড়ার ভাষায়-
কেউ পারেনি করতে কভু
এই ভাষণের বিকৃতি
ইতিহাসে নিয়ে এলো
বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি!
এই ভাষণে নড়েছিল
পাকবাহিনীর ভিতটা
সেই সূত্রে এসেছিল
বাঙালিদের জিতটা…।