সিলেটে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ব্যাপক ছড়াছড়ি, সিসিকের আল্টিমেটাম

22
পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার ও বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অবাধে ব্যবহার ও বিক্রি হচ্ছে এ পলিথিন ব্যাগ। ছবিটি নগরীর বন্দরবাজার থেকে তোলা। ছবি- মামুন হোসেন

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেট নগরীতে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট বড় সব বাজারেই এখন পলিথিন ব্যাগের ছড়াছড়ি। এগুলো জব্ধ বা জরিমানা করতে প্রশাসনের তৎপরতা থাকলেও রহস্যজনক কারনে গত ২ থেকে ৩ বছর ধরে সিলেটে বড় ধরনের কোনো পলিথিন ব্যাগের চালান জব্ধ বা আটক করতে দেখা যায়নি।
অথচ রাতের আঁধারে সিলেটে প্রবেশ করছে ট্রাক বোঝাই পলিথিন ব্যাগের চালান। একবার ব্যবহারের পরই এগুলো ফেলে দিতে হয়। পরে এসব পলিথিন ব্যাগ ড্রেনে ও মাটিতে মিশে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে। কিন্তু টনক নড়ছে না আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী ও পরিবেশ অধিদপ্তরের। এদিকে, গণমাধ্যমে সিসিকের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। মহানগরী এলাকার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সিলেট সিটি কপোরেশন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটের নিষিদ্ধ পলিথিনের মূল উৎস হচ্ছে নগরীর লালদীঘিরপার, হকার্স মার্কেট ও কালিঘাট এলাকা। এখান থেকে আবার বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, রিকাবীবাজার, মদিনা মার্কেট ও আখালিয়া এলাকাসহ সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ যাচ্ছে। সেখান থেকে আবার খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট ফেরি অথবা দোকান থেকে ক্রয় করে বিক্রিতেরা মালামাল কিনার সময় ক্রেতার হাতে এ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তুলে দিচ্ছেন। পরে এটা মাটিতে পড়ে যেমন পরিবেশ দূষণ করছে তেমনি ড্রেন, নদী, নালা, খাল, বিল ও পুকুরে পড়ে পানির গতিপথে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি পানি ও মাটি দূষণ করছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের কালোবাজারী একটি চক্র পুলিশ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অথবা অসাধু কিছু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পলিথিন ব্যাগের চালান সিলেটে নিয়ে আসছে তারা। বেশী ক্ষেত্রে দেখা গেছে ঢাকা থেকে ট্রাকবোঝাই করে পলিথিন ব্যাগের চালান প্রথমে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ফরিদপুর, বদিকোনা, লাউয়াই, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের লাগোয়া মেঠোপথের একটি বাড়িতে মজুদ করা হয়। আবার কখনো এই পলিথিন চালান শহরতলীর টুকেরবাজার এলাকার তেমুখী সেতুর আশপাশের একটি বাড়ি ও খাদিম ও গোটাটিকর বিসিক এলাকার আশপাশের কয়েকটি বাড়িতেও মজুদ রাখা হয়। বর্তমানে সরাসরি ঢাকা থেকে নিষিদ্ধ এই পলিথিন ব্যাগের চালান সিলেট এসে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করছে। কিন্তু যখন আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা থাকে তখন বড় বড় চালানগুলো মৌলভীবাজার ও দক্ষিণ সুরমার কুশিঘাটের একটি বাড়িতে গুদামজাত করে রাখা হয়। পরে সুযোগ বুঝে এসব চালান থেকে নগরী হকার্স মার্কেট, লালদীঘিরপার ও কালিঘাটের কয়েকটি দোকানসহ শহরতীর বিভিন্ন পাইকারী দোকানে পিকআপ করে মুরগীর ফিডের বস্তায় ভরে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের চালান পৌছে দেয়া হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, সিলেটে পলিথিনের ৭ গডফাদারের একটি তালিকা আছে পুলিশের কাছে। এই তালিকাভূক্তদের একাধিকবার আটকও করা হয়েছিল। নগরীর কালিঘাট ও লালদীঘিরপার হকার্স মার্কেটে প্রবেশের সময় ট্রাকসহ জব্ধ করা হতো পলিথিনের চালান। ওই সময় এসব গডফাদার অন্তকলহে জড়িয়ে পড়ায় একজন অন্যজনের চালানের খবর পৌছে দিতো আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীর কাছে। ধরপাকড় আতংকে ও নিজেদের কোন্দলে তালিকাভুক্ত পলিথিনের চোরাকারবারিরা নগরী ছেড়ে ছিলো। গত ২ থেকে ৩ বছর ধরে আবার তারা সিলেটে ফিরে এসেছে। আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে সোর্সদের মাধ্যমে আতাঁত করে এরা পলিথিন ব্যবসায় ফের সক্রিয় হয়েছে।
জানা গেছে, সিলেট নগরী ও শহরতলীর বিভিন্ন হাট-বাজারে এখন দেদারছে মিলছে পলিথিন ব্যাগ। বাজারে মাছ, তরিতরকারি ছাড়াও ছোট ছোট অন্যান্য মালামাল ক্রয় করতে প্রকাশ্যে এসব পলিথিন ছড়াচ্ছে। পরে এসব পলিথিন ব্যাগ ড্রেনে মাটিতে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করছে।
সিসিকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেট মহানগর এলাকায় পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করতে সকল ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। গত ২১ ফেব্র“য়ারী সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক দেশকে পলিথিনমুক্ত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে সিলেট মহানগরী এলাকার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বন্দরবাজারের ব্যবসায়ী সুপ্রিয় এর সাথে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি জানান, বিভিন্ন হাঠ-বাজারে ব্যাপক পলিথিনের ছড়াছড়ি থাকায় পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তার চেয়ে বেশী ক্ষতি হচ্ছে মাটি। যদি এখনই এই পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিজেরদের থেকে বন্ধ না হয় তাহলে আমরা হুমকীতে পড়বো।
নগরীর বন্দরবাজারের ফুটপাতের সবজি বিক্রেতা নিজাম উদ্দিনকে পলিথিন ব্যাগ ক্রয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসবাদ করলে তিনি বলেন, হকার্স মার্কেট থেকে প্রতিদিনই পলিথিন ব্যাগ ক্রয় করা হয়।
বন্দরবাজারের ফেরি করে পেঁয়াজ-রসুন বিক্রেতা কামাল উদ্দিনকে পলিথিন ব্যাগ ক্রয় করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি আঙ্গুল দেখিয়ে বলেন, এই সিটি মার্কেটের কয়েকটি দোকানের পরই (অন্য ব্যবসার আড়ালে) পলিথিন ব্যাগ বিক্রয়কারীদের কাছ থেকে ব্যাগগুলো তিনি ক্রয় করেছেন।
নগরীর আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা সুমন রায় পলিথিন ব্যাগে করে মাছ তরিতরকারী কিনে বাসায় ফিরছিলেন। এসময় নগরীর সিটি পয়েন্টে তার সাথে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে অভ্যাস হয়ে গেছে। কিছু কিনলেই ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যাগে করে আমাদের দিচ্ছে আর আমরা এর প্রতিবাদ না করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আর এই পলিথিন ব্যাগ মাটিতে পড়ে পরিবেশ দুষিত করছে। তিনি বলেন, আমি পলিথিন ব্যাগগুলো বস্তায় ভরে প্রতি সপ্তাহ পরে জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলি।
নগরীর বন্দরবাজারের এক পানের দোকানদার মাছ, সবজি ও ক্ষুদ্র পরিচিত ব্যবসায়ীদের কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে ৪ ধরনের পলিথিন ব্যাগ বিক্রি করে আসছেন। তার নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে তিনি বলেন, নগরীর লালদীঘিরপার হকার্স মার্কেট পাইকারী দোকান থেকে পলিথিন ব্যাগ ক্রয় করে ১০ থেকে ১৫ টাকা লাভে তিনি ব্যাগগুলো বিক্রি করে থাকেন। একেকটি প্যাকেটে ৩৫ থেকে ৪৫/৫০ টা ব্যাগ থাকে। এতে প্রতিদিন শুধু এই পলিথিন ব্যাগ বিক্রি করে বাড়তি ৫০০/৬০০ টাকা লাভ করে থাকে। তিনি বলেন, এসব পাইকারী দোকানদার পলিথিন ব্যাগগুলোর চালান পুলিশকে টাকা দিয়ে তারা লালদীঘিরপার ও হকার্স মার্কেটে নিয়ে এসে আমাদের কাছে বিক্রি করেন। এর সংখ্যা হবে ৪০ থেকে ৫০ জন পলিথিন কারবারী। তিনি আরো বলেন, পাইকারী দোকানের কর্মচারীরাও বাসায় পলিথিন ব্যাগ রেখে ফেরি করে নগরীর বিভিন্ন দোকানে পৌছে দেয়। তিনি বলেন, যদি পলিথিন ব্যাগের তৈরীর কারখানাগুলো আগে-বাগে বন্ধ করে দেয়া না হয় তাহলে নগরী ও গ্রাম্য হাট-বাজারে এসব নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন ব্যান্ডের খাদ্য দ্রব্যের পণ্য পলিথিনের প্যাকেটে ভরে বিক্রি হচ্ছে সেটিও বন্ধ করতে হবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্মসচিব) বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, আমরা কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমে পলিথিন ব্যবহার বন্ধের জন্য সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নির্দেশে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছি। ৭দিন পর নগরী থেকে যদি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ও ছড়াছড়ি বন্ধ না হয় তাহলে আমরা অভিযানে নামবো। আর অভিযানে নামার আগে লোকজনকে এ ব্যাপারে আরো জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মাইকিং করা হবে। তিনি বলেন, এটা আসলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ। তার পরেও আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে পরিবেশ বান্দব সিলেট সিটি কর্পোরেশন গড়ে তুলতে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। এর বিকল্প হিসেবে পরিবেশ ও মাটি রক্ষার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে চটের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। তা হলেই পলিথিন ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, বিষাক্ত পলিথিন ব্যাগে খাবার এনে খাওয়া ঠিক নয়। এটা জেনেও পলিথিন ব্যাগ যারা ব্যবহার করছেন আমি মনে করি সেটা থেকে প্রতিটি মানুষ বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আমরা আগামীতে পরিবেশের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে হুমকীতে পড়বো। এছাড়া কাচামাল, পলিথিন ব্যাগ তৈরীর কারাখানা ও পলিথিন তৈরীর মূল উৎসস্থলকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে এসএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড কমিউনিটি সার্ভিস) মো: জেদান আল মুসা জানান, এসএমপি এলাকায় বাহিরের জেলা থেকে পলিথিনের চালান নিয়ে এসে যারা ব্যবসা করছেন তাদের ৭ থেকে ১০ জনের একটি তালিকা রয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো: ছালাহ উদ্দিন চৌধুরীর ল্যান্ডফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।