কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত কয়েক বছরের মতো এবারও নকলমুক্ত পরিবেশের মধ্য দিয়েই চলছে এসএসসি ও সমমানের দাখিল আর এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষা। যথারীতি এবারও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত পরীক্ষার্থীর কম সংখ্যা সবার মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু কমছে না ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অনুপস্থিত ও ঝরে পড়ার উদ্বেগজনক সংখ্যা দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষাতেই কেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকছে পাঁচ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। ৮ পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল প্রায় অর্ধলাখ। যাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করলেও মাত্র দুই বছরেই ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে আছে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী!
মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার এই উদ্বেগজনক চিত্র। এদিকে নকল বন্ধ ও বহিষ্কারের সংখ্যা কমলেও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে অব্যাহত ঝরে পড়ার বিশাল সংখ্যায় উদ্বিগ্ন দেশের শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার আগের তুলনায় কমছে এ কথা সত্য কিন্তু কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সংখ্যা এখানও আছে উদ্বেগজনক পর্যায়েই। বিশেষজ্ঞরা ঝরে পড়া ও হলে অনুপস্থিত থাকার কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করে রোধ করতে হবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। কেননা কেবল নকল কমালেই শিক্ষার লক্ষ্য পূরণ হবে না।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাধারণত ঝরে পড়া বলতে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফরম পূরণ না করা শিক্ষার্থীদেরই বলা হচ্ছে। এই সংখ্যা উদ্বেগজনক। আবার ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে না আসার মতো ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও আছে উদ্বেগজনক পর্যায়েই।
এ বছর মাধ্যমিক অর্থাৎ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত ৩ ফেব্রুয়ারি। পরীক্ষা শুরুর আগেই দেখা গেল এ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকা প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। মাত্র দু’বছরে ঝরে পড়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার শিক্ষার্থী। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে গত দু’বছর আগে নবম শ্রেণীতে ১১ শিক্ষা বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করেছিল মোট ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৮ জন। যাদের এ বছর এ পাবলিক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। অথচ তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৮৮ জন পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে। পরিসংখ্যান বলছে, নবম শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজনই ঝরে পড়ছে। সরকারের উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার সহায়তার কারণে এ স্তরের শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও ঝরে পড়া কমছে না।
কমপক্ষে ১০০ জন পরীক্ষা দিচ্ছে এমন প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই বলছেন, নবম শ্রেণীতে ১০০ জন নিবন্ধন করলেও ৭০ জনের বেশি পরীক্ষায় আসছে না।
সবচেয়ে ভাল মানের কিছু প্রতিষ্ঠানে ঝরে পড়ার হার কিছুটা কম হলেও ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে এ হার উদ্বেগজনক। একই সঙ্গে নির্বাচনী বা টেস্ট পরীক্ষায় কোন বিষয়ে ফেল করলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার একটি আদেশও ঝরে পরার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে বলছেন শিক্ষকরা। ভাল ফল দেখাতে অনেক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনী পরীক্ষায় সামান্য খারাপ করলেও তুলনামূলক দুর্বল শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসতে দিচ্ছে না। ফলে অনেকের ওই অবস্থাতেই শিক্ষা জীবন শেষ হচ্ছে।
এত গেল ঝরে পড়ার একটি চিত্র। এ সঙ্গে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এখন পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষাতেই কেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী। যাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
গত কয়েক বছরের মতো এবারও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃতদের সংখ্যা অনেক কম, কিন্তু চিন্তার কারণ অনুপস্থিতি। জানা গেছে, দেশের ৯টি সাধারণসহ ১১ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিনে বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষায় বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র একজন। কিন্তু ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি পাঁচ হাজার ৪৪৭ শিক্ষার্থী।
চার ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় পরীক্ষায় সারাদেশে বহিষ্কার হয়েছে ১৮ জন, কিন্তু পরীক্ষায় আসেনি পাঁচ হাজার ৫৬১ শিক্ষার্থী। ৬ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার ৭৯ শিক্ষার্থী কিন্তু অনুপস্থিত ছিল পাঁচ হাজার ৮৬৯ জন। ৯ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার হয়েছে ১৭৬ জন কিন্তু অনুপস্থিত ছিল ছয় হাজার ৬০ জন। ১১ ফেব্রুয়ারি অনুপস্থিত ছিল ছয় হাজার ৯৩৯ শিক্ষার্থী, অথচ বহিষ্কার ছিল মাত্র ১৩৪ জন। ১২ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার হয় ২০ জন, কিন্তু অনুপস্থিত ছিল পাঁচ হাজার ১৭৪ শিক্ষার্থী। ১৩ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার দুইজন কিন্তু কেন্দ্রে আসেনি চার হাজার ৫৭৩ জন। ১৫ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার একজন, কিন্তু অনুপস্থিত পাঁচ হাজার ১৩৩ জন। সর্বশেষ সোমবার অনুষ্ঠিত পরীক্ষাতেও ফরম পূরণ করে কেন্দ্রে আসেনি পাঁচ হাজার ৪৪৭ শিক্ষার্থী। বহিষ্কার হয়েছে ২৫ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, তাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। তবে শিক্ষাবোর্ড ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আগামী বছর পরীক্ষা দিতে পারে। তবে অনুপস্থিতির ব্যাপক হার ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শিক্ষার্থীদের এই অব্যাহত ঝরে পড়ার পরিস্থিতি সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পথে বড় অন্তরায়। যদিও এ ঝরে পড়া ও অনুপস্থিতি নিয়ে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে ভাল কোন গবেষণাও নেই।
কি কারণে ঝরে পড়ছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও শিক্ষাবিদরা বলছেন, বছরের পর বছর এভাবে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে নানা কারণে। প্রধান কারণ হিসেবে বলছেন, পুরোপুরি অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ায় ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া, অসচেতনতার জন্য বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য, নদীভাঙ্গন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে।
মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা নির্ধারণ ও এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থানা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির। তিনি বলেছেন, ভর্তির হার এখন আশাব্যঞ্জক। তবে ঝরে পড়া রোধ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে এখনই ঝরে পড়া কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভর্তির পর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সচ্ছলতা আনতে অভিভাবকরা স্কুল থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নিচ্ছেন। সে কারণেই বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে নবম শ্রেণী পর্যন্ত।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর অকৃতকার্য শিক্ষার্থী পরবর্তীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে সত্য। বিদ্যালয়ে ভর্তির হারও আশাব্যঞ্জক, তবে প্রাথমিক সমাপনীতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার যে তফাৎ, তা আসলে উদ্বেগজনকই। এ বিষয়ে সরকারের কাজ করা জরুরী। কিন্তু সঙ্কট সমাধানের উপায় কী? এমন প্রশ্নে এ শিক্ষাবিদ বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে সরকার বৃত্তি, উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই ও খাবার সরবরাহসহ আরও নানা খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা করলেও শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আসলে কেবল নবম থেকে সমস্যা নয়। দেখা যাবে প্রথম শ্রেণীতে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে তার অর্ধেকেরও বেশি এসএসসির আগে ঝরে পড়ছে।
আমি মনে করি সঙ্কট সমাধানে সরাকারী উদ্যোগে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারিত করতে হবে। উপজেলায় সরকারী উদ্যোগে কারিগরি স্কুল হতে হবে। মাধ্যমিক স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করে কোনমতে চালাতে ফল পাওয়া সম্ভব হবে না। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যুক্ত হবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরাও। সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার চিন্তা থেকে আগে বের হতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলছিলেন, টানাপোড়েনের সংসারে ছেলেদের পাঠানো হচ্ছে কাজে। আর নিরাপত্তার কারণে মেয়েদের আগেই স্কুল থেকে সরিয়ে নিয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করতে হলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে শিক্ষাকে। ঝরে পড়া কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। বন্ধ করতে হবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ।
শিক্ষার নানা সঙ্কট নিয়ে কাজ করা এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেছেন, সরকারী তথ্য থেকেই বেরিয়ে আসছে যে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সরকার শিক্ষার পেছনে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। তারপরও পাঁচজনের মধ্যে একজন ঝরে যাওয়া আমাদের জাতীয় পর্যায়ে বিনিয়োগের একটা বড় অপচয়। যা অবশ্যই উদ্বেগের। এক্ষেত্রে ঝরে পড়ার অন্যান্য কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারীভাবে এই ঝরে পড়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। তবে এ নিয়ে সরকারী পর্যায়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। তখন প্রকৃত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যাবে। আর সেই অনুযায়ী প্রতিকারের উপায় বের করা সহজ হবে।