কাজিরবাজার ডেস্ক :
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন সংশোধনে হাইকোর্টের রায়ের পরও কিডনি সংযোজন কার্যক্রমের জটিলতা কাটছে না। আইন সংশোধন করে বিধিমালা প্রণয়নের কাজ এখনও হাতে নেয়া হয়নি। দক্ষ চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আদালতের রায় অনুযায়ী স্বল্পমূল্যে দেশের মানুষের কাছে কিডনি সংযোজনের সেবা পৌঁছে দিতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
গত ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে আইনী জটিলতার অবসান ঘটে। মানবিক বিবেচনায় কিডনিসহ মানবদেহের যে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিকটাত্মীয় ছাড়াও অন্য কাউকে দান করা যাবে। কিন্তু কেনাবেচা করা যাবে না বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কাউকে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করার সুযোগ না থাকা সংক্রান্ত ‘মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন’র তিনটি ধারা সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। অবৈধভাবে কিডনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নিতেও সরকারের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। আদালতের এ রায় বাস্তবে কার্যকর করতে হলে বিদ্যমান আইন সংশোধন এবং বিধিমালা তৈরি করতে হবে, যা এখনও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে বেঁধে দেয়া ৬ মাসের মধ্যে দেড় মাস চলে গেছে। এখনও কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। দেশে কিডনি সংযোজনে সক্ষম এমন হাসপাতালের সংখ্যা হাতেগোনা। কিডনি সংযোজন করা হয় প্রায় অর্ধেক হাসপাতালের যথাযথ সক্ষমতা নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিডনি সংযোজনে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত দক্ষ চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের চরম সঙ্কট রয়েছে। এর মধ্যে ডায়ালাইসিস ব্যবসায়ী চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কিডনি সেন্টার গড়ে তুলতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে সকল সঙ্কট কাটিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনে হাসপাতাল এবং সার্জনসহ দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্যসংখ্যক প্রতিস্থাপন হচ্ছে যার সংখ্যা গড়ে ২৫০। আর কিডনিদাতার যোগান থাকলে দেশে মাত্র ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে অনায়াসেই কিডনি প্রতিস্থাপন করিয়ে নেয়া যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিদেশে এ খরচ পড়বে ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, নিকটাত্মীয় ব্যতীত মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করার সুযোগ না রাখা সংকীর্ণতা। পরে গত ২১ নবেম্বরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তাদের বক্তব্য দাখিলের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। গত ৫ ডিসেম্বর রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও মোঃ শাহীনুজ্জামান শাহীন।
বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা সংশোধনের বিষয়ে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিচিত এবং সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তিরা চাইলে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। এ রায়ের ফলে নিকটাত্মীয় ছাড়া কেউ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবে নাÑ এমন বিধান আর কার্যকর থাকছে না। এ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা ছয় মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের সংশোধন করতে হবে।
মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯-এর ২(গ) ধারায় দাতার সংজ্ঞা দেয়া রয়েছে। সংজ্ঞায় দাতা হিসেবে নিকটাত্মীয়দের কথা বলা আছে। আর নিকটাত্মীয় বলতে বাবা-মা, ভাই-বোন, পুত্র-কন্যা, চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রীকে বলা হয়েছে। ভারতে এ বিষয়ক আইনে নিকটাত্মীয়ের সংজ্ঞায় ওই কজন ছাড়াও নানা-নানি, দাদা-দাদি, খালাতো, মামাতো, চাচাতো ভাই-বোনের কথা বলা আছে। হাইকোর্ট এই বিধান সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে। ভারতের আইনে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতিতে নিকটাত্মীয় ছাড়াও অন্যরা দাতা হতে পারেন। এক্ষেত্রে ওই আইনে নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে কারা বিশেষ পরিস্থিতিতে দাতা হতে পারবেন। আমাদের আইনে দাতাকে ১৮ থেকে ৬৫ বছর পর্যন্ত বয়সের ব্যক্তি হতে হবে। মেডিক্যাল বোর্ডের ছাড়পত্র নিতে হবে। আইনের এ বাধ্যবাধকতার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের জটিলতা দূর করে দিয়েছেন আদালত। এতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের দরকার হবে এমন রোগীদের জীবন রক্ষা পাবে। পাশাপাশি নিজ দেশে স্বল্প ব্যয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরও বলেন, দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশে প্রায় ১০ হাজার কিডনি বিকল রোগী প্রতি বছর কিডনি প্রতিস্থাপন করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র দশটি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে বছরে প্রায় ২৫০টি কিডনি সংযোজন হয়ে থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ কিডনি প্রতিস্থাপন সেন্টার গড়ে তুলতে ন্যূনতম ১০ কোটি টাকার দরকার পড়ে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ন্যূনতম ৮শ’ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তাই ২০১৮ সালের সংশোধিত বাংলাদেশের ‘মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন’ আইনের কিছুটা পরিবর্তন আনা দরকার ছিল। ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়ার তুলনায় কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যয় অনেক কম। তাই রক্তের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ না রেখে যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে কিডনি দানের অনুমতি দেয়া দরকার ছিল। এক্ষেত্রে কিডনিদাতা ও গ্রহীতা নির্ণয়ের জন্য এবং অবৈধ কিডনি বাণিজ্য প্রতিরোধ করতে সরকারী উদ্যোগে ‘প্রত্যয়ন প্রদানকারী বোর্ড’ গঠন করে দিতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালাইসিস দেয়ার তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরে অধ্যাপক ডাঃ মহিবুল্লাহ খন্দকার বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। দেশে বছরে প্রায় ২৫০টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। দেশে কিডনি সার্জনের সঙ্কট রয়েছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপনকারী সার্জন সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। এভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকলরোগী স্বাভাবিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিডনিদাতার যোগান থাকলে মাত্র ২ লাখ টাকা দিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করানো সম্ভব। আর একই কাজ ভারতে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৪০ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে এক থেকে দেড় কোটি টাকা এবং আমেরিকার মতো উন্নত দেশে তা ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হবে। দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন সেন্টার গড়ে তোলা সম্ভব। ডায়ালাইসিস শুরু করলে তা চালিয়ে যেতে হয় আজীবন। একজন কিডনি রোগীকে প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিসের পেছনে ব্যয় করতে হয় গড়ে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। ডায়ালাইসিসের এই উচ্চ ব্যয় গরিব রোগী তো দূরের কথা, অনেক ধনাঢ্য পরিবারের রোগীর পক্ষেও আজীবন বহন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ডায়ালাইসিস করানোর তিন বছরের খরচ দিয়ে অনায়াসেই কিডনি প্রতিস্থাপন করিয়ে নেয়া যায়। তবে কিডনিদাতার পথ সুগম করে দিতে হবে।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশেও কিডনি রোগের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে কিডনিদাতার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোসহ সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো উচিত। অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনের সময়োপযোগী সংস্কার, সংশোধন ও সংযোজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশে প্রায় ১০ হাজার কিডনি বিকল রোগী প্রতি বছর কিডনি প্রতিস্থাপন দ্বারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র দশটি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে বছরে প্রায় ২৫০টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ন্যূনতম ৮শ’ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের আইনী জটিলতা কেটে গেলে উপরোক্ত অনেক সমস্যা থেকে রেহাই পাবেন রোগী ও রোগীর অভিভাবকরা। কিডনিদাতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
কার্যকর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাণিজ্য শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের কিডনি বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল আলম। তিনি বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপন বৈধতা পাওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষজন বিশেষ করে ছিন্নমূল এবং শরণার্থীরা অভাবের তাড়নায় কিডনি বিক্রি করতে আগ্রহী হতে পারেন। কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প দিকগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত বাংলাদেশের। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোয় ৮০-৯০% কিডনি প্রতিস্থাপন হয় ‘ব্রেনডেড’ রোগীর থেকে। এদিকে আমরা এক শতাংশ সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। এদিকটায় আমরা মনোযোগ দিতে পারি। অঙ্গ বিনিময় পদ্ধতিও কাজে আসতে পারে। ধরেন, একটি ফ্যামিলির কারও কিডনি দরকার কিন্তু তার পরিবারের যিনি দিতে আগ্রহী তারটা ম্যাচ হচ্ছে না। আবার আরেক রোগীর ফ্যামিলিতেও একই সমস্যা। তখন এই দুই রোগীর পরিবার ফেয়ার ডোনেশনের ভিত্তিতে কিডনি আদান প্রদান করতে পারেন বলে মনে করেন রফিকুল আলম।