আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি জসীমউদদীনের ‘একুশের গান’ কবিতায়-‘আমার এমন মধুর বাঙলা ভাষা/ ভায়ের বোনের আদর মাখা/ মায়ের বুকের ভালবাসা।’ আবার কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায়-‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়-। এ রকম অসাধারণ সব কবিতার জন্ম দিয়েছে মহান ভাষা আন্দোলন। মাতৃভাষা আন্দোলনের ওপর দেশ-বিদেশের বহু কবি সাহিত্যিক নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। এ কারণেই বাংলাভাষা এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে।
বদরুদ্দীন উমরের ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ-কতিপয় দলিল’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ সালের কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গঠিত কর্মপরিষদ স্মারকলিপি দেয়। ওই স্মারকলিপিটি ৪৮ সালের ২ এপ্রিল যুগান্তরে প্রকাশিত হয়। স্মারকলিপিতে কর্মপরিষদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে : আধুনিক যুগে কোন কোন রাষ্ট্রে একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হইয়াছে। বেলজিয়ামে ফ্লেমিং ও ফরাসী ভাষা), কানাডায় (ইংরেজী ও আফ্রিকান), সুইজারল্যান্ডে (ফরাসী, জার্মান ও ইতালীয়), দক্ষিণ আফ্রিকায় (ইংরেজী ও আফ্রিকান), মিসরে (ফরাসী ও আরবী), শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ডে (থাই ও ইংরেজী), পাশের দেশ ভারতে সাংবিধানিকভাবে ২২ ভাষা স্বীকৃত। এর বাইরে আরও কয়েক শ’ ভাষায় দেশটির জাতিগোষ্ঠী কথা বলেন। রাশিয়ায় ১৭ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাকে কেন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের কয়েকটি মৌলিক অধিকার আছে। কাজেই যে পর্যন্ত না আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলন চালাইয়া যাওয়া হইবে।’
মাতৃভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল পাকিস্তান জন্মের আগেই। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল এটা ঐতিহাসিক সত্য। এই সময় পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে যাদের আধিপত্য ছিল তার বেশির ভাগই ছিল হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী শ্রেণীর। এ কারণে মুসলমানরা এই সময় মুসলিম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। এটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তান জন্মের পর এদের আশা হতাশায় পরিণত হলো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে বাঙালিদের তেমন আধিপত্য রইল না। ক্রমেই শোষণ বঞ্চনার শিকার হতে লাগল পূর্ব বাংলার মানুষ। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে লাগল। নানা শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়ে তারাই আবার পাকিস্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় সঞ্চারিত হতে লাগল। এরপর এলো মাতৃভাষা বাংলার ওপর আক্রমণ। গর্জে উঠল সমগ্র বাঙালি সমাজ। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফূরণ।
’৪৭ সালের শেষের দিকে করাচীতে একটি একটি শিক্ষা সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। সে সময় পাকিস্তানের ডাকটিকেট, মানি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি উর্দু ও ইংরেজীতে লেখা থাকত। তখন থেকেই বাংলাকে উপেক্ষার শুরু। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ফজলুর রহমান, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। যদিও এরা দু’জনেই ছিলেন বাঙালি অথচ তারা উর্দুকে সমর্থন দিলেন। সে সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ’৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে গণপরিষদের সভা বসল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বিল আনা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের এক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই বাঙালি। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে কেন রাষ্ট্রভাষা করা হরে না? সেদিন তাকে তিন গণপরিষদে সদস্য ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও প্রেমহরী বর্মণ সমর্থন জানান। ভাষাসৈনিক ডাক্তার ননীগোপাল সাহা রচিত ‘আমার দেখা ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি’ গ্রন্থে এভাবেই মাতৃভাষা বাংলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে।