কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উন্নয়ন ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাই বর্তমান সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ কারণে সারাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকান্ড ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। শহর ও গ্রামের মানুষকে সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে সরকার কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী রবিবার দুটি পানি শোধনাগার প্রকল্প, দুই সেতু, কয়েকটি ট্রেনসার্ভিস, আর্থিক লেনদেনে মোবাইল এ্যাপস ও বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ১২ ঘণ্টা সম্প্রচার কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের উদ্বোধন করার সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। খবর স্টাফ রিপোর্টার নিজস্ব সংবাদদাতার।
প্রধানমন্ত্রী এদিন স্থানীয় জনগণের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘শেখ রাসেল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ ও খুলনা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ‘বঙ্গবন্ধু ওয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের উদ্বোধন করেন। অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছেÑ বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব-তারাকান্দি-জামালপুর-ঢাকা রুটে একজোড়া নতুন আন্তঃনগর ট্রেন ‘জামালপুর এক্সপ্রেস’, ঢালারচর-পাবনা-রাজশাহী রুটে ‘ঢালারচর’ এক্সপ্রেস ও ফরিদপুর রুটে ‘রাজবাড়ী এক্সপ্রেস’ ট্রেনের রুট বর্ধিতকরণ, চট্টগ্রাম-সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে উদয়ন ও পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের র্যাক পরিবর্তন ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ডিজিটাল আর্থিক সেবা প্রদানে মোবাইল এ্যাপসভিত্তিক ‘পল্লী লেনদেন’ কার্যক্রম। পাশাপাশি এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘গুরুত্বপূর্ণ ৯টি ব্রিজ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় ১৫০০০ মিটার চেইনেজে তিতাস নদীর ওপর ৫৭৫ মিটার পিসি গার্ডার সেতু ও মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলাধীন মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর আরএইচডি রাস্তায় কালিগঙ্গা নদীর ওপর ৪৫৬ মিটার পিসি গার্ডার সেতু উদ্বোধন। এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ১২ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম ওয়াসার যৌথ অর্থায়নে প্রায় ১৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ কোটি লিটার পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। এর আগে ২০১৮ সালের নবেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় শোধনাগারটি। হালদা নদী থেকে পানি তুলে ৬ ধাপে পানি পরিশোধন শেষে সরবরাহ লাইনে দেয়া হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে পানির চাহিদা রয়েছে ৪২ কোটি লিটার। আর ওয়াসার সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি লিটার। এর মধ্যে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার থেকে ১৪ কোটি লিটার, মোহরা পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার, শেখ রাসেল পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার এবং নলকূপ থেকে ৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হয়। নতুন প্রকল্পটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরে বিশুদ্ধ পানির সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে ২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ থেকে দৈনিক ১১ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করা সম্ভব হবে। যা স্থানীয় ৭৫ শতাংশ পানির অভাব পূরণসহ খুলনা শহরের আরও ১৫ লাখ জনগণ সেবার আওতায় আসবে। প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প উদ্বোধনকালে সকলকে পানি সাশ্রয়ের বিষয়টি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমাদের পানি পরিশোধনে যে ব্যয় তার চেয়ে অনেক কম টাকা জনগণের কাছ থেকে নেয়া হয় কাজেই পানির অহেতুক অপচয় করবেন না। স্থানীয় সরকার বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ ৯ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার তিতাস নদী ও মানিকগঞ্জ সদরের কালিগঙ্গা নদীর ওপর দুইটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তিতাস নদীর ওপর ৫ দশমিক ৭৫ মিটার সেতুটি নির্মাণে ৩৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং কালিগঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত ৪৫৬ মিটার সেতুটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
অর্থমন্ত্রী এএইচএম মুস্তাফা কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ মজিবুর রহমান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম এবং তথ্য সচিব কামরুন নাহার তাদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের চিত্র তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এছাড়াও পিএমও সচিব মোঃ তোফাজ্জ্বল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকবৃন্দ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃণমূলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া কখন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটা দেশের সার্বিক উন্নয়ন করতে হলে শুধু রাজধানীভিত্তিক উন্নয়ন করলেই হবে না, একেবারে গ্রামের মানুষ, তৃণমূলের মানুষদের উন্নতি করতে হবে। সূচনা বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়া পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের উপকারভোগী, চট্টগ্রামের পানি শোধনাগারের উপকারভোগী, খুলনা পানি শোধনাগারের উপকারভোগী, চট্টগ্রামে টেলিভিশনের উপকারভোগী ও জামালপুরের রেল ব্যবহারকারী উপকারভোগীদের সঙ্গে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তার ২৪ বছরের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের মধ্যদিয়ে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাবে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যে সংবিধান দিয়ে গেছেন তাতে সকলের এই মৌলিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
দেশের সাড়ে ৩ হাজার ইউনিয়নে ইন্টারনেট ব্রডব্র্যান্ড সেবা পৌঁছে দেয়া, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণসহ তথ্য প্রযুক্তি খাতে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। ‘লেনদেন’ ভিত্তিক মোবাইল এ্যাপস উদ্বোধনের ফলে সৃষ্ট নানা সুযোগ-সুবিধারও উল্লেখ করেন। রেল যোগাযোগের উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপসমূহের উল্লেখ করে তিনি বলেনÑ পাবনা, ঢালারচর, জামালপুরসহ আরও বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। রেলের মাধ্যমে মানুষ যেমন নিরাপদে যেতে পারে আবার যাতায়াতও সাশ্রয়ী হয়। সে কারণে আমরা রেল সার্ভিসের ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছি। এইক্ষেত্রে রেলওয়ের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে যে, আমরা রেল লাইন বাড়াচ্ছি ও নতুন নতুন বগি এবং যাত্রী পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি। তবে, রেলের পুরনো ব্রিজগুলো, কালভার্টের ওপর ব্রিজসহ বিভিন্ন রেল ব্রিজগুলো মেরামত করতে হবে। এগুলো অত্যন্ত পুরনো হয়ে যাওয়ায় রেল চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টিসহ যাত্রী নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। পূর্ববর্তী সরকারের (বিএনপি) আমলে রেল বন্ধ করে দেয়ায় বিভিন্ন রেলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই এমনটি হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘সে সময়কার সরকারের এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। যে কারণে বছরের পর বছর চলে গেছে এসব ব্রিজ মেরামত করা হয়নি। তারা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে রেলের লোকবলকে বিদায় করে দিয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গার লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদেশে সার্ভে করে যেখানে যত পুরনো রেল ব্রিজ আছে সেগুলো মেরামত করতে হবে। এজন্য একটা প্রকল্প গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। ক্ষমতায় আসার পর আমরা অনেক পানি শোধনাগার করেছি। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আমরা পানি শোধনাগার করেছি। আমার একটা অনুরোধ থাকবে, পানি ব্যবহারের সময় যেন সবাই মিতব্যয়ী হই। অনেক টাকা খরচ করে পানি শোধন করে সেই পানি সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে নোনা পানির জন্য খুলনাবাসীর পানির অভাব তীব্র ছিল। তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য মধুমতি নদী থেকে পানি এনে শোধন করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ১ লিটার পানি শোধন করতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। কাজেই পানির অপচয়টা সবাই বন্ধ করবেন। কল ছেড়ে দিয়ে ব্রাশ করা, সেভ করা বা কল ছেড়ে দিয়ে গোসল করা -এগুলো কেউ করবেন না। প্রয়োজনে বালতি ও মগ ব্যবহার করবেন।