নতুন বছরের শুরুতে সর্বজনীন পেনশন চালুর প্রস্তুতি

28

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নতুন বছরের শুরুতে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম’ চালু করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে সরকারী-বেসরকারীখাতে যারা চাকরি করছেন তাদের এই সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া ‘কর্মক্ষম নাগরিক’ যাদের বয়স ১৮-৫৫ বছরের মধ্যে তাদের পেনশন সুবিধা দেবে সরকার। অর্থাৎ সবাই সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে বেসরকারী চাকরিজীবীদের পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করতে নিয়োগকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয়া হবে। এছাড়া সরকারী চাকরিজীবীদের চলমান পেনশন সুবিধা বাড়াতে কিছুটা সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হতে পারে। জানা গেছে, দীর্ঘ চার বছরের চেষ্টায় অবশেষে সর্বজনীন পেনশন সুবিধা কার্যকর করতে এর রূপরেখা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়েছে। আগামী নতুন বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থবিভাগ। এলক্ষ্যে বছরের শেষদিন আজ মঙ্গলবার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে নীতি ও কৌশল প্রণয়নের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে অর্থমন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগ। সর্বজনীন পেনশন সুবিধা বাস্তবায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চলতি বাজেটে ঘোষণা দিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, সরকারী চাকরিজীবীদের পাশাপাশি এখন দেশের সাধারণ মানুষের জন্যও পেনশন চালুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এর জন্য খুব শীঘ্রই ‘ইউনিভার্সাল পেনশন অথরিটি’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, সরকারী পেনশন যারা পান, তারা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ভগ্নাংশ মাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ দেশের সব মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে।
জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন সুবিধার আওতায় প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া কর্মক্ষম নাগরিক বিশেষ করে রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, কাজের বুয়া, ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আনা হবে। এদের বয়স হবে ১৮-৫৫ বছরের মধ্যে। মাসিক কিস্তি হতে পারে ১০০-৫০০ টাকা। যে পরিমাণ কিস্তি নেয়া হবে সমপরিমাণ টাকা সরকারী তহবিল থেকে পেনশনারের হিসেবে জমা হবে। নির্দিষ্ট ব্যাংক কিংবা বীমা কোম্পানির মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ ও পেনশন প্রদান কিংবা হিসাব সংরক্ষণ করা হবে। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একটি সুরক্ষিত সার্ভারে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে হওয়ার কারণে একজন পেনশনধারী ঘরে বসে অলাইনে তার আইডি ও হিসাব সম্পর্কে জানতে পারবেন।
এছাড়া পেনশনের টাকা জমা দিতে পারবেন বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে একজন হিসেবধারীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম গ্রহণ করা হবে। মেয়াদ শেষে ন্যূনতম ৫ লাখ টাকার একটি তহবিল পাবেন পেনশনধারী। তবে এই টাকার ওপর তিনি প্রতিমাসে ৪-৫ হাজার টাকার মুনাফা পাবেন। যদি বিশেষ প্রয়োজনে টাকার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে পেনশন তহবিল থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করা যাবে। তবে কোনভাবেই পেনশন হিসাব বন্ধ করাকে উৎসাহিত করা হবে না। সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে আহরিত টাকা বিনিয়োগ করবে সরকার। সেই বিনিয়োগের লভ্যাংশ থেকে পেনশনধারীদের লাভ দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আজিজুল আলম বলেন, নতুন বছরের শুরু থেকে দেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নীতি কৌশল প্রণয়ন ও পুরো প্রক্রিয়াটি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে একটি রূপরেখা দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইউনিভার্সেল পেনশন অথরিটি গঠন করা হবে। ওই অথরিটি সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, এটি মূলত দেশের পিছিয়ে পড়া সাধারণ কর্মক্ষম মানুষকে সুবিধা দিতে করা হচ্ছে। বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেশের ৪ কোটি মানুষ সুবিধা পাচ্ছেন। এ কারণে সরকারকে বছরে ব্যয় করতে হচ্ছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন সুবিধা দেয়া গেলে সবাই পেনশন নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবেন।
জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় পেনশন তহবিল হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ পেনশন হিসেবধারী যে পরিমাণ টাকা জমা করবেন ঠিক ততটাই সরকারী তহবিল থেকে দেয়া হবে। অর্থাৎ প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে বছরে কারো হিসেবে ১২শ’ টাকা জমা হলে সরকারী তহবিল থেকে আরও ১২শ’ টাকা দিয়ে মোট ২৪শ’ টাকার তহবিল গঠন করা হবে। তবে বেসরকারী ক্ষেত্রে চাকরিজীবী ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ তহবিলে অর্থ দেবে। এর পরিমাণ হতে পারে চাকরিজীবীর মূল বেতনের শতকরা ১০ ভাগ। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও সমপরিমাণ অর্থ দেবে। সরকারী ও বেসরকারী খাতে একই নিয়মে তহবিল গঠন করা হবে। বেসরকারীখাতে পেনশন নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিবে সরকার। দেশের সব বেসরকারীখাতে পেনশন সুবিধা কার্যকর করতে নির্দেশনা দেয়া হবে।
জানা গেছে, পেনশনের এ তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি রেগুলেটরি অথরিটি থাকবে। এ অথরিটির মাধ্যমে পেনশন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। লাভজনক খাতে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। বিনিয়োগ সুরক্ষাও দেয়া হবে। এ থেকে যে মুনাফা আসবে, তার অংশ মাসে মাসে পাবেন সুবিধাভোগীরা। পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেয়া হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সুবিধা থাকবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের সবাই এখানে অংশ নিতে পারবে না। আমাদের এখনও ১১-১২ শতাংশ মানুষ আছে, যাদের আমরা হতদরিদ্র বলি। যাদের কোন নিট আয় নাই। আমাদের রাজনৈতিক শক্তির প্রথম টার্গেট ওই নিচের ১১-১২ ভাগ মানুষকে টেনে ওপরে আনা।
পেনশন সংস্কারের যৌক্তিকতা
জনমিতিক কাঠামোর পরিবর্তন, নির্ভরশীলতার হার, প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, গ্রাম হতে শহরে অভিপ্রয়াণ, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন, আনুষ্ঠানিক বনাম অনানুষ্ঠানিকখাত, সরকারী বনাম বেসরকারীখাত, শ্রমশক্তির সম্প্রসারণ, প্রবাসী জনশক্তি, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অসহনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সর্বজনীন পেনশন একটি ভাল উদ্যোগ। এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার হবে। দ্রুত এটি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রবাসীদেরও পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে হবে। অনেক প্রবাসী চাকরি জীবন শেষে খালি হাতে দেশে ফিরে আসেন। এছাড়া কেন্দ্রীভূত পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন হলে স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাটাবেজ প্রণয়ন প্রস্তুতাধীন, ভৌতিক পেনশনার সমস্যার সমাধান, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পেনশন কেস প্রস্তুত ও নিষ্পত্তি, পেনশন পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও ইএফটির ব্যবহার, পিএও এর অনুকূলে পেনশন বাজেট বরাদ্দ ও জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।