কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধে লক্ষণ ও সংক্রমণপ্রবণ এলাকাভিত্তিক কৌশল নির্ধারণে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি ২০৩০ সালের আগেই দেশ থেকে কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা প্রদানে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ওষুধ তৈরি এবং বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কুষ্ঠ রোগীদের চাকরিচ্যুত এবং সমাজ থেকে বের করে দেয়ার মানসিকতা বদলাতে হবে। সহানুভূতিশীল, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কুষ্ঠ রোগীদের দেখতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কুষ্ঠ রোগী তারাও মানুষ, আমাদের সমাজের একজন। কারো কুষ্ঠু রোগ দেখা দিলে তাকে চাকরি থেকে বের করে দিতে হবে, তাকে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দিতে হবে- এই মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে। আমরা হাম-পোলিও, রুবেলার মতো রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময়ে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন রোগ একে একে আমরা দূর করেছি। ২০৩০ সালের আগেই বাংলাদেশকে কুষ্ঠমুক্ত করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ। আর কেউ যেন নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত না হয় আমাদের সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই, জনসচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরী এবং আমরা এ বিষয়ে বিশেষ নজর দিচ্ছি।
বুধবার সকালে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য কুষ্ঠ উদ্যোগ’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলন-২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, আমাদের দেশে অনেক ওষুধ কোম্পানি রয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানি করে এবং তাদের ওষুধের মান খুবই ভাল। তাই আমি তাদের বিশেষায়িত ওষুধ তৈরি করার জন্য অনুরোধ জানাতে চাই যা কুষ্ঠ রোগীদের জন্য দরকার। এসব ওষুধ রোগীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করুন যা দ্রুত আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুরুতেই যদি কুষ্ঠ রোগী হলে কী কী লক্ষণ পাওয়া যায়, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই যদি আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেই, তাদের নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিÑ তাহলে কিন্তু এই রোগটা আর বৃদ্ধি পায় না। তারা পঙ্গুত্ববরণ করেন না। নতুন কেউ যেন আক্রান্ত না হয় সেটাও দেখতে হবে। সেই বিষয়টা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্তভাবে প্রয়োজন। আমরা সেভাবেই দৃষ্টি দিচ্ছি।
রাজধানীর মহাখালীতে প্রয়াত স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সরকারী বাসভবনে অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দেখতাম, এই কুষ্ঠ রোগীরা প্রায় ৫০/৬০ জন বা কখনও একটু কম, কখনও একটু বেশি তারা ওখানে আমার কাছে চলে আসত। কেন আসত আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আসলেই আমি তাদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতাম, খাদ্য দিতাম। যা ঘরে থাকত আমি তাদের দিতাম’।
এরপর বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মিন্টু রোডের বাসায় থাকার সময় এবং বঙ্গবন্ধু ভবন খুলে দেয়ার পর বিভিন্ন দিবসে ও প্রতিটি ঈদে কুষ্ঠ রোগীরা দেখা করতে আসতেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের জন্য আমি খাবারের ব্যবস্থা, কম্বল, কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা রাখতাম। তাদের সবাইকে আমি খাবার যা থাকত দিতাম এবং সবাইকে ১০০ টাকা করে দিতাম। প্রথম প্রথম অনেকেই তাদের (কুষ্ঠ রোগীদের) খাবার দিতে যেতে চাইত না। মনে করত কাছে গেলেই যেন কী হবে। আমি নিজে যখন দেয়া শুরু করলাম, কাছে যাওয়া শুরু করলাম, আমার সঙ্গে যারা ছিল তারাও তখন আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়াত। তখন আমি বলেছিলাম, যদি কখনও সরকারে যেতে পারি আপনাদের (কুষ্ঠ রোগী) জন্য একটা ব্যবস্থা আমি করব।’
২০৩০ সালের আগেই কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় কুষ্ঠ কার্যক্রম জোরদার করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, এ লক্ষ্যে আমরা যদি আন্তরিকভাবে কাজ করি, তাহলে আমরা লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের অনেক আগেই কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবো।’ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে আচরণ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী কুষ্ঠ আক্রান্ত লোকদের প্রতি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করার প্রযোজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমি দেশবাসীকে বলতে চাই যে, তারা (কুষ্ঠরোগী) আমাদের সমাজেরই অংশ। তাই তাদের দূরে ঠেলে দেয়া সঠিক নয়। কোন ব্যক্তির দেহে কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত হলে, আপনাদের সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ করতে হবে এবং তিনি যাতে সুস্থ হয়ে ওঠেন সে লক্ষ্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি খুবই জরুরী।’
প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে কুষ্ঠ রোগীদের দেহে রোগটি শনাক্ত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ প্রদান করে বলেন, কুষ্ঠ রোগের কারণে প্রতিবন্ধী লোকদের উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের কোন বিকল্প নেই। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চাকরি থেকে অবশ্যই বাদ দেয়া যাবে না, বরং প্রতিবন্ধী লোকের জন্য একটি অনুকূল কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনে তাঁর সরকারের দীর্ঘ পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই রোগ নির্মূলে নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। তখন সেই সব পদক্ষেপের সুফল হিসেবে ১৯৯৮ সালে দেশে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারে একজনে নামাতে সক্ষম হয়েছিলাম। এর মানে আমরা ২০০০ সালের পরিবর্তে ১৯৯৮ সালের মধ্যেই এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছিলাম।
শেখ হাসিনা বলেন, উত্তরবঙ্গ ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা বেশি। এই রোগের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আমাদের ওই এলাকাগুলোতে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে এবং কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি আমরা এটা করতে পারি তবে, ২০৩০ সালের মধ্যেই আমরা একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়তে পারব ইনশাল্লাহ।
তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে ৩৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ কুষ্ঠ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসত। তবে এই হার এখন হ্রাস পেয়ে আট শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটা তাঁর সরকারের একটি অনেক বড় অর্জন। এখন সরকারী-বেসরকারী সংস্থাসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাঁর সরকার এই হারকে শূন্যে নামিয়ে আনতে চাইছে।
শেখ হাসিনা বলেন, কুষ্ঠ রোগের বিরুদ্ধে সামাজিক বৈষম্য দূরের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত মানুষের জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত পুরনো আইন পরিবর্তন করে ২০১১ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। তিনি বলেন, কুষ্ঠ রোগীদের কারাগারের মতো কোন বাড়িতে আলাদা করে আটকে রাখার বিষয় নয়। তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সমাজের অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং এই রোগমুক্তির জন্য চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে হবে।
সরকারপ্রধান এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আর কেউ যেন নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত না হয় আমাদের সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই জনসচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরী এবং আমরা এ বিষয়ে বিশেষ নজর দিচ্ছি। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার ৫শ’ থেকে ৪ হাজার কুষ্ঠ রোগী আক্রান্ত লোক শনাক্ত হচ্ছে এবং উপজেলা সদর হাসপাতাল ও কুষ্ঠ হাসপাতালগুলোতে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি তাঁর সরকারের বিশেষ অঙ্গীকার রয়েছে। আমরা তাদের দূরে ঠেলে দিতে পারি না। তাদেরও সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার আছে এবং আমরা তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। আর আমাদের সবাইকে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই ‘কানাকে কানা ও খোঁড়া কে খোঁড়া’ না বলার জন্য শিক্ষা দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ ও আধুনিকায়ন এবং আইনের বাস্তবায়ন করছে। তাদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও পরিবহন সুবিধা দিতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে তিনি কুষ্ঠ রোগীদের জন্য দ্রুত বিশেষ আবাসন প্রকল্প গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এই নির্দেশনার ফলে প্রতিবন্ধীদের জন্য গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে বান্দাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগ নিরাময় কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সকল বেসরকারী সংস্থাকে তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং কুষ্ঠ রোগী তথা কমিউনিটির সেবার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন কুষ্ঠ রোগ সম্পর্কে সচেতন। সরকার এবং এনজিওগুলোর অব্যাহত প্রচার কার্যক্রমের ফলে এই সচেতনতা তৈরি হয়েছে। ঢাকা, সিলেট ও নীলফামারী জেলায় সরকারের তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল কুষ্ঠ আক্রান্তদের চিকিৎসা ও সেবা সুবিধা প্রদান করছে। সর্বোপরি কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে দাতা দেশগুলোর সহযোগিতায় অনেক এনজিও বিভিন্ন জেলায় হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের গৃহীত স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন সম্ভব করেছে। মান এবং স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্র উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হয়েছে এবং এর ফলে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ টিকাদান কার্যক্রম বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা পোলিও, হাম, রুবেলার মতো রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময়ে সক্ষম হয়েছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাপানের নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ডব্লিওএইচও গুডউইল এ্যাম্বাসেডর ইওহেই সাসাকাওয়া বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। কুষ্ঠ রোগ ও এর চিকিৎসার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত একটি প্রামাণ্য চিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়।