সাহেদা আক্তার
বিদ্যালয়ের টিফিন পিরিয়ড চলছে। জানালা দিয়ে রাস্তায় চোখ পড়তেই লোকজনের দৌড়াদৌড়ি, শোরগোল শুনে একটু বোঝার চেষ্টা করলাম কি হয়েছে; বিদ্যালয়ের দপ্তরি দৌড়ে এসে খবর জানাল, “ম্যাডাম, শাম্মী পুকুরে পড়ে গেছে, অনেক পানি খেয়েছে। বাড়ির সবাই মিলে মাথায় তুলে গোড়ানো দিল, পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না”। হাসপাতালে নেয়া হলো। বুকের ভেতরটা অচেনা এক ব্যথায় কুকড়ে উঠলো আর চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো শ্রেণিকক্ষে তার আধো আধো বোল, অকারণে হাসি আর কথা বলা। ক্লাসে সবকিছুর উত্তর দেয়ার চেষ্টা। শাম্মী বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। সহজ সরল বুদ্বিপ্রতিবন্ধী অথচ পড়ালেখায় আগ্রহ তার বেশি। বিশেষ করে কোনও কিছু লিখা বা আঁকার প্রতি দারুণ ঝোক। ক্লাসে গেলেই শাম্মী কাছে চলে আসতো, নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলতো। আজও একটা সুপারি হাতে দিয়ে বলল, “ম্যাডাম, এটা আপনার জন্যে”। হাসিমুখে বললাম, “ম্যাডাম তো সুপারি খাইনা, তুমি নিয়ে যাও”। বোঝা গেল মনটা তার কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করতে লাগলাম সে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরলাম। বিকাল পাঁচটার দিকে ফোনটা বেজে উঠতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল, শাম্মীর কোনও খবর নয় তো? দৌড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম দপ্তরীর কল, রিসিভ করে কোনও কিছু জিজ্ঞেস না করেই জানতে চাইলাম, “শাম্মীর কি খবর?” উত্তরে সে জানালো, “ম্যাডাম, শাম্মী মারা গেছে”। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কোনোভাবেই নিজেকে সান্তনা দিতে পারলাম না। সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। বার বার মনে হতে লাগলো গতরাতেও সে তার বাবা-মায়ের সাথে, তার পরিবারের সাথে ছিল; আর আজ মাটির নিচে। কত নিষ্ঠুর পৃথিবী! জন্ম নিলেই মরতে হবে এটা চিরসত্য কিন্তু অকালে যে প্রাণ যায় তা মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। পরদিন স্কুলে গেলাম। চারদিকে যেন নীরবতা, সে নীরবতা যেন শাম্মীর জন্যে। ক্লাসে এক মিনিট নীরবতা পালন করলাম, তার রুহের মাগফিরাত কামনা করলাম কিন্তু ক্লাসে মনযোগ দিতে পারলাম না। শাম্মীর হারানোর বেদনা পুরো মনের শক্তিকে যেন কেড়ে নিয়ে গেল। তার শূন্যতায় যেন শ্রেণিকক্ষ হাহাকার করতে লাগলো। তার অন্য সকল সহপাঠী শ্রেণিকক্ষে আছে শুধু সে-ই নেই। শাম্মী আর কখনো কাছে এসে বলবে না-“ম্যাডাম, আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে!” সে আকাশের তারা হয়ে সবাইকে ছেড়ে দূর আকাশে হারিয়এ গেল; আর তা ভাবতে ভাবতে চোখ গড়িয়ে কখন যেন অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, নিজেই বুঝতে পারলাম না। সম্বিত ফিরে পেলাম যখন রাহিদ এসে বলল, “ম্যাডাম ঘণ্টা পড়ে গেছে”।