কাজিরবাজার ডেস্ক :
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। কারসাজি করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে শাস্তি নিশ্চিত করবে সরকার। ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্টে শুধু সামান্য জরিমানা দিয়েই আর ছাড় নয়! সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে পেতে হবে বড় শাস্তি। কিভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়-সেই পরামর্শ নেয়া হবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এ লক্ষ্যে আজ রবিবার এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে একটি গোলটেবিল বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে সরকারের সংশ্লিষ্ট চার মন্ত্রী ও এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।
এদিকে, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিনিয়ত দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। আমদানি ব্যয়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি দামে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে দেশে। পকেট ফাঁকা হচ্ছে সাধারণ ভোক্তার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। সিন্ডিকেটের দায়ভার পড়ছে পুরো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে কর্মকৌশল নির্ধারণে পরামর্শ ও মতামত দিয়ে সহযোগিতা করবে শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই।
জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে কাজ করছে সরকার। ভোজ্যতেল ও চিনি সিন্ডিকেটরা চিহ্নিত হয়েছে বেশ ক’বছর আগে। অসাধু এসব ব্যবসায়ী সরকারের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা ইতোমধ্যে করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এই তালিকায় রয়েছে চালকল মালিক, পাইকার ও আড়তদার ব্যবসায়ীরা। এরা সব সময় সরকারের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। কিন্তু মসলাজাতীয় পণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের অসাধু ব্যবসায়ীরা বরাবর ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কয়েক বছর ধরে বাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে পেঁয়াজ, রসুন ও আদা। আদা ও রসুন প্রায় সারাবছর ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। এখন প্রতিকেজি আদা ও রসুন জাত ও মানভেদে ১৬০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৩০০ টাকায় উঠলে টনক নড়ে সরকারের। এখন দ্রুত পেঁয়াজ আমদানি ও উৎপাদন বাড়ানোসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর কথা জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু পেঁয়াজের বাজার অস্থির করার পেছনে মূল কারসাজি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের। গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এর প্রমাণ রয়েছে। আর ওই প্রমাণের ভিত্তিতেই সম্প্রতি আড়াই হাজার ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, যার অধিকাংশ পেঁয়াজ ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কয়েক হাজার টন মজুদ পচা পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা সাগর ও নদীতে ফেলে দেন। মূলত বেশি মুনাফার আশায় এসব পেঁয়াজ মজুদ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড দুর্গন্ধের কারণে পচা পেঁয়াজ বেশিদিন মজুদ করে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহজে এসব ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এদের শাস্তি দেয়ার কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি সচিবালয়ে তিনি জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরকে ইঙ্গিত করে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানাসহ সব ধরনের শাস্তি দিন। আর ক্ষমা করা যায় না। অসাধু সিন্ডিকেট এসব ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
জানা গেছে, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় পেঁয়াজ অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে বেশি মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সংস্থাটি পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি ও নৈরাজ্যের জন্য ৪৭ আমদানিকারককে চিহ্নিত করেছে। অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে ২৫-২৬ নবেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া এনবিআরের নজরদারিতে রয়েছে আরও ৩৪১ প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জানিয়েছেন, অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমদানি ব্যয়ের তুলনায় মজুদের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট করে অতিরিক্ত মুনাফা করা অন্যায় ও অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইনে এদের বিচার করা সম্ভব। এখন এদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
জানা গেছে, চাল, পেঁয়াজ, ডাল ও চিনিসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এফবিসিসিআইয়ের অধিভুক্ত। গত কয়েক বছর দেশে কয়েকটি ভোগ্যপণ্য ভোক্তাদের ভোগালেও পণ্যমূল্য কমাতে শীর্ষ সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম দেখা যায়নি। তবে আজ রবিবার সংগঠনটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের সভাপতিত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, এনবিআর চেয়ারম্যান, প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, টিসিবি ও ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা। এফবিসিসিআইয়ের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক, পাইকার ও আড়তদার ব্যবসায়ীরা বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। সভায় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শ চাওয়া হবে। এছাড়া কোন্ পন্থা অবলম্বন করলে পণ্য সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে তা নির্ধারণে কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। ব্যবসায়ীদের মতামত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করবে সরকার।
জানা গেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে (চাল, ডাল, গম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, গরম মসলা, চিনি, লবণ, মাছ, মাংস ও পোল্ট্রি) নিয়ে আলোচনা করা হবে। সারাবছর এসব পণ্যের চাহিদা, বাংলাদেশে পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুদ ব্যবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনামূলক আলোচনা হবে বৈঠকে।
পেঁয়াজের অতিরিক্ত দামে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বেড়েছে। এছাড়া রেকর্ড খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেও সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। আর এজন্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় অতি মুনাফাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে ভোগ্যপণ্যের কোন সঙ্কট নেই। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করলে সরবরাহ কমেছে ঠিক। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে মজুদ করে পেঁয়াজের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়। এর প্রমাণ সরকারের কাছ রয়েছে। তিনি বলেন, মজদুকারী, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারী এবং অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেশের প্রচলিত আইনে দেয়া সম্ভব। এরপরও যেহেতু বার বার অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে তাই নতুন করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। কেউ দেশের আইনের উর্ধে নয়।