কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুজবে কান না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গুজব ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমরা দেখি, অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়। আমি সবাইকে একটা কথা বলব, এই অপপ্রচারে কান দেবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন অপপ্রচার, বিশেষ করে পেঁয়াজ লবণ প্রভৃতির সঙ্কটের অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ওরা এটা করবে আমি জানি, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই সেটাকে মোকাবেলা করেই আমাদের চলতে হবে, আমরা সেভাবেই চলছি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একথা বলেন।
দেশের একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পেঁয়াজ, লবণ এবং চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সাম্প্রতিক অপচেষ্টার প্রেক্ষিতে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশ গড়ার কাজ করতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে অবদান রেখে যাবে। সর্বাবস্থায় চেইন অব কমান্ড মেনে ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশ গঠনে সশস্ত্র বাহিনীর অঙ্গিকার বজায় থাকবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। সশস্ত্র বাহিনীকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে আলাদা ইনস্টিটিউট, একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগও সেনা সদস্যরা বুক পেতে মোকাবেলা করছেন। এছাড়া রোহিঙ্গা সদস্যদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়েও তারা প্রশংসনীয় কাজ করছেন। দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশনেও আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রশংসা পেয়েছেন। এ সময় বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হওয়া সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। সশস্ত্র বাহিনীর নারী সদস্যদেরও প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। বিভিন্ন মিশনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। সশস্ত্র বাহিনীতে তার সরকারই প্রথম নারী সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে তিন বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ করা শুরু হয়। আজকে তাদের বিভিন্ন সাফল্যে এখন দেশের সুনাম হচ্ছে।
সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সিলেট, কক্সবাজারের রামু ও বরিশালের পটুয়াখালীতে পৃথক তিনটি পদাতিক ডিভিশন গড়ে তোলা হয়েছে। বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা ব্যবহারে নৌবাহিনী কাজ করছে। দেশে এখন যুদ্ধজাহাজ বানানোর কাজ চলছে। নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। তারা এখন জলে স্থলে সব জায়গায় কাজ করছেন। বিমানবাহিনীর জন্য বিভিন্ন উন্নত উপকরণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। অল্পদিনের মধ্যে বিমানবাহিনীও উন্নত একটি বাহিনীতে পরিণত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন। প্রযুক্তি ও আধুনিক উপকরণের মাধ্যমে প্রতিটি বাহিনীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলাদা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমাদের মিলিটারি একাডেমি আজ বিশ্বে প্রশংসিত। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজেরা নিজেদের দেশ গড়ে তুলতে চাই। কারও থেকে সাহায্য নিয়ে আর চলতে চাই না। আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর ও শান্তির একটি দেশ রেখে যেতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক কাঠামোর উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রী মিলিটারি একাডেমি, কম্বাইন্ড আর্মড স্কুল ও প্রতিটি কোরের জন্য ট্রেনিং স্কুলসহ আরও অনেক সামরিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে একটি অত্যাধুনিক নৌবাহিনী গঠন করার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু এক সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৩টি ঘাঁটি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে ১৯৭৩ সালেই আধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমানসহ হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান এবং এয়ার ডিফেন্স র্যাডার ইত্যাদি সংযোজনের মাধ্যমে এদেশে একটি আধুনিক বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরে জাতির জনক একটি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় বুনিয়াদ তৈরি করে যান।
প্রধানমন্ত্রী আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আছে সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন। আমার ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় ভাই শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ১৯৭৫ সালে রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দান করেন। ছোট ভাই শেখ রাসেলেরও ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি যে কোন দুর্যোগ কবলিত অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবা ও জান মাল রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করে আসছে।
সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের মানুষ ভাল আছে। তারপরও একটি গোষ্ঠী চাল নেই, লবণ নেই বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। যাহোক এসব মোকাবেলা করে আমাদের চলতে হবে।
এই অনুষ্ঠানে তিনি ২০১৯-২০ সালে সশস্ত্রবাহিনীর শান্তিকালীন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী পদক এবং অসামান্য সেবা পদকপ্রাপ্ত সদস্যদের পদক তুলে দেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে, প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষ যেন ভাল থাকে, সে লক্ষ্যে আমরা নানা কর্মসূচী গ্রহণ করছি। যাদের ঘর নেই, তাদের ঘর দিচ্ছি। যাদের জমি নেই, তাদের জমি দিচ্ছি। গুচ্ছগ্রাম, আদর্শ গ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে অনেককে পুনর্বাসন করছি।
তিনি বলেন, গরিবের সন্তানরা যেন লেখাপড়া করতে পারে, সেজন্য বৃত্তি-উপবৃত্তি দিচ্ছি। বিনা পয়সায় ছেলেমেয়েদের বই দেয়া হচ্ছে। আজকের শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে পারে, তারা যেন এ দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে, সেজন্যই আমরা এ কাজগুলো করছি। সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা আপনাদের সন্তান, নাতি-পুতিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবেন। তারা যেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে। দেশকে ভালবাসতে পারে। যুদ্ধ করে আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি। বাঙালী বীরের জাতি, এ কথা যেন নতুন প্রজন্মের সন্তানরা জানতে পারে। ভবিষ্যত প্রজন্ম বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবে। কারণ, আমরা বীরের জাতি। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বলেন, ‘বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’
এদিকে দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়। নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশের সব সেনানিবাস, নৌ ঘাঁটি ও স্থাপনা এবং বিমানবাহিনী ঘাঁটির মসজিদসমূহে দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং সশস্ত্র বাহিনীর উত্তরোত্তর উন্নতি ও অগ্রগতি কামনা করে ফজরের নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। সকাল থেকে বিভিন্ন কর্মসূচীতে যোগদিতে প্রধানমন্ত্রী সেনাকুঞ্জে এসে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টাসহ সেনাবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) সস্ত্রীক তাঁকে স্বাগত জানান।
এই সংবর্ধনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধান বিচারপতি, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, ডেপুটি স্পীকার, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার, বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, মুখ্য সচিব, সংসদ সদস্য (ঢাকা এলাকার) সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, তিন বাহিনীর সাবেক প্রধান, ২০১৯ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল বীরশ্রেষ্ঠের উত্তরাধিকারী, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঢাকা এলাকায় বসবাসরত খেতাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তাঁদের উত্তরাধিকারী, উচ্চপদস্থ অসামরিক কর্মকর্তা এবং তিন বাহিনীর চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে।