কাজিরবাজার ডেস্ক :
দীর্ঘ নয় বছর পর বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সন্তোষ প্রকাশ করলেও বেরিয়ে আসছে একের পর এক অস্বচ্ছ ও অনিয়মের উদ্বেগজনক চিত্র। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একটি চক্রের কারসাজিতে এমপিওভুক্ত করার বিশাল কর্মযজ্ঞ প্রশ্নের মুখে পড়লেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় ‘আশার আলো’ দেখছিলেন ঘটনার জন্য দায়ী কর্মকর্তারা। তবে একে একে বেরিয়ে আসছে যুদ্ধাপরাধী, জিয়াউর রহমানসহ বিএনপি নেতাদের নামের বহু প্রতিষ্ঠান, অর্থ লেনদেন, অস্তিত্বহীন এমনকি সরকারী প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তুঘলকি সব ঘটনা। ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান’ নামেরই চারটি প্রতিষ্ঠানের এমপিও দিয়ে সঠিক ইতিহাসকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যেই এমপিও পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। মন্ত্রী সভার সদস্য ও সরকারদলীয় এমপিদের ডিও লেটারে (চাহিদাপত্র) প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি না হলেও নামসর্বস্ব, অস্থিত্বহীন, একাডেমিক স্বীকৃতিবিহীন, ট্রাস্ট পরিচালিত, যুদ্ধাপরাধী ও বিএনপি নেতাদের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা কীভাবে এমপিওভুক্তি হলো- তা নিয়ে হচ্ছে সমালোচনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ২১টি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের তালিকা পেয়েছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরেও অনির্ধারিত আলোচনায় কয়েকজন মন্ত্রী এবারের এমপিওভুক্তির তালিকা নিয়ে অসন্তোষ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এবার ‘শহীদ’ জিয়াউর রহমান নামের ন্যূনতম চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানকে শহীদ স্বীকৃতি দিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পেছনে কাজ করেছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী আমলারা। এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তবে এমপিওভুক্তি নিয়ে জটিলতা যাতে আরও ঘণীভূত না হয় সেজন্য বদলির বিষয় গোপন রাখা হচ্ছে।
সরকার গত ২৩ অক্টোবর দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে আদেশ জারি করে। এই তালিকার বহু প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক ওঠে। এমপিওভুক্তির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত নেতাদের প্রতিষ্ঠিত ন্যূনতম চারটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত চারটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। এছাড়া সরকারী হওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান, এমপিওভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান, ভাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত দুটি প্রতিষ্ঠান এবং অবকাঠামা না থাকা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয়েছে। এজন্য তালিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারী দলের এমপি-মন্ত্রীদের দেয়া তালিকা থেকে এমপিওভুক্ত না করে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। অযোগ্য, যুদ্ধাপরাধী ও বিএনপি নেতাদের প্রতিষ্ঠান এমপিও করার পেছনে মন্ত্রণালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী আমলাদের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ কাজে বিপুল অর্থ লেনদেনেররও অভিযোগ এসেছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করছে, কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে সফটওয়্যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠান তালিকা থেকে সব শর্তপূরণ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
নানা তথ্য আনার প্রেক্ষাপটে এমপিওর সঙ্গে জড়িত অদক্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মত দেন সাবেক শিক্ষাসচিব মোঃ নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত সময় পেলেও এমপিওভুক্তির নির্ভুল তালিকা করতে না পারার দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। তালিকাভুক্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অদক্ষতায় গড়পড়তা সমালোচনা শুনতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারকে।
তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় আরও বলেছেন, দেখলাম প্রায় অস্তিত্বহীন, যুদ্ধাপরাধী প্রতিষ্ঠিত, সরকারীকৃত প্রতিষ্ঠানও এমপিওর তালিকায়। শুধু তাই নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধন হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় দক্ষতার সঙ্গে পুরো তালিকা ওয়েবসাইটে দিতে পারেনি। সনাতন পদ্ধতিতে নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দিয়েছে যা শুনে মন খারাপ হয়েছে।
তিনি বলেন, ফেসবুকের ইনবক্সেও ডজন ডজন অনিয়মের তথ্য পেলাম। সংক্ষুব্ধরা সমালোচনা করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের। অথচ এই ভুল তালিকার দায় মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তার। ভুলের জন্য সফটওয়্যারের দোহাই দেয়াকে হাস্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, সফটওয়্যারে সঠিক ইনপুট দেয়ার যোগ্যতার ঘাটতি ছিল কর্মকর্তাদের।
এমপিওভুক্তির অনুমোদন স্থগিত চেয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কলেজটি বাণিজ্যিক ভবনের ২য় তলা হতে ৬ষ্ঠ তলা পর্যন্ত ভাড়া করা ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে। নিচতলায় রেস্টুরেন্ট অগ্নিকা- ঘটার ঝুঁকিতে আছে। একটি অস্তিত্ববিহীন জমির দলিলাদি তৈরি করে কর্তৃপক্ষকে ধোঁকা দিয়ে এমপিওভুক্তির আবেদন করা হয়েছে। জমিটি খারিজ করতে গেলে এই গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ে।
‘নরসিংদী আইডিয়াল কলেজ ও নরসিংদী বিজ্ঞান কলেজ’ ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকেও এবার এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। জামালপুরের ‘দিগপাইত শামছুল হক ডিগ্রী কলেজে’ একটি শাখার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী এমনকি একাডেমিক স্বীকৃতি না থাকলেও এমপিও তালিকায় নাম উঠেছে। অথচ একই কলেজের এইচএইসসি (বিএম) শাখায় এমপিওভুক্তির সব শর্তই বিদ্যমান; কিন্তু সেটির এমপিও হয়নি।
দিগপাইত শামছুল হক ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মহির উদ্দিন তালুকদার বলেন, এ কলেজের কৃষি ডিপ্লোমা শাখায় শিক্ষক, কর্মচারী ও একাডেমিক স্বীকৃতি নেই। এই শাখায় বর্তমানে মাত্র চারজন শিক্ষার্থী আছে। কীভাবে এই শাখা এমপিওভুক্ত হলো সেটা আমার জানা নেই।’