বেলুন ফোলানোর সিলিন্ডার বিস্ফোণে ৬ শিশুর করুণ মৃত্যু

21
রূপনগরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহতদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় বেলুন ফোলানোর একটি সিলিন্ডারে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ৬ শিশুর করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে ১২ শিশুসহ ১৭ জন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বুধবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুদের বয়স ৮-১০ বছরের মধ্যে। আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মোস্তাক আহম্মেদ। নিহতদের নাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক জানাতে না পারলেও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিহতরা হলো ফারজানা (৭), নূপুুর (১১), রুবেল (১০), রিয়া (১০), শাহীন (৯) ও রমজান (৮)। তাদের মধ্যে পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায় রিয়া।
এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, রূপনগরের বিস্ফোরণের ঘটনায় আমাদের এখানে পাঁচ শিশুর মরদেহ এসেছে। আহতাবস্থায় এসেছে পাঁচজন। এদের মধ্যে দুইজন চিকিৎসাধীন। তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঢামেকে ভর্তি হওয়া আহতরা হলো- জুয়েল (২৫), সোহেল (২৬), জান্নাত (২৫), বোন তানিয়া (৮), ভাই বায়েজিদ (৫), জামেলা (৭), অজ্ঞাত পরিচয় শিশু (৫- তার অবস্থা আশঙ্কাজনক), মীম (৮), ওজুফা (৯), মোস্তাকিম (৮), মোরসালিনা (৯), নিহাদ (৮), অর্ণব ওরফে রাকিব (১০), জনি (১০) ও সিয়াম (১১)। এদের মধ্যে প্রথম ১৪ জনকে হাসপাতালের জেনারেল বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে ১১ জন শিশু, একজন নারী ও দুইজন পুরুষ। সিয়াম বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন। হাসপাতাল থেকে জানা যায় আহত শিশুদের ছয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়াও রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী উপ-পরিদর্শক আব্দুল খান বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় ঢামেকে ভর্তি হওয়া এক শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। সোহেলের অবস্থাও গুরুতর। তানিয়া-বায়েজিদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম আছে। অন্যদের শরীরেও জখম রয়েছে।
সন্ধ্যায় সরজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায় ঘটনাস্থল রূপনগর শিয়ালবাড়ির ফজর আলী মোল্লার বস্তি। নিচে পানি ওপরে বাঁশের মাচায় প্রতিটি ঘর। বিশাল এ বস্তিতে প্রায় তিন হাজার লোকের বসবাস। বস্তির সামনে তিন রাস্তার মোড়েই বেলুন বিক্রেতার প্রতিদিনের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছিল বেলুন। ক্রেতার বেশির ভাগই শিশুকিশোর। তারা পছন্দসই বেলুন কিনলে তা ফুলিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের করে দেয়া হয়।
বিকেল পৌনে চারটায় ওই তিন রাস্তার মোড়ে ছিল জনাপঞ্চাশেক লোকজন। অধিকাংশই বস্তির বাসিন্দা। এ সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। তারপর দিগি¦দিক ছোটাছুটি। মুুহূর্তে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় জনা বিশেক নারী ও শিশুর খন্ড বিখন্ড দেহ। ঘটনাস্তলেই মারা যায় ৫ জন। যাদের চারজনই শিশু। সাত বছরের ফারজানা তাদের একজন। ফারজানারা পাঁচ বোন। তিন হাজার টাকায় ভাড়া বস্তির একটা ঘরে তাদের বসবাস। ফারজানার অপর বোন মরিয়মও বিস্ফোরণে আহত। তার বড় বোন গার্মেন্টসকর্মী আয়শা জানান, বিকেলে ফারজানা বেলুনওয়ালার পাশেই ছিল। হঠাৎ সেখানে বিকট শব্দে সব শেষ হয়ে যায়।
নিহত রুবেলের বাবা নুরুল ইসলাম ও মা পারভীন সাংবাদিকদের জানান, তাদের একটি ছেলে ওই বস্তিতে পানিতে পড়ে মারা গেছে। এবার বেলুনে মরেছে রুবেল। বেলুন বিস্ফোরণে এত মানুষ একসঙ্গে মারা যায় এটা তারা কল্পনাও করেনি কখনও।
সজন মিয়া নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই বেলুনওয়ালা বিকেল তিনটার দিকে সেখানে তার ছেলেকে নিয়ে হকারি করছিল। ছয় মাস ধরেই তিনি এখানে বস্তির বাসিন্দাদের কাছে বেলুন বিক্রির কাজ করতেন। বিস্ফোরণে তিনি নিজে আহত হয়েছেন তার ছেলেটাও প্রাণহারা হয়েছে। যদিও এখনও তার নাম পরিচয় কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। তিনি নিজেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলাম জানান- বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ভ্যানের পাশে থাকা কয়েকজন শিশুর মরদেহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের কর্মকর্তা রাসেল সিকদার জানান, বিকেলে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট। এরপর মরদেহ ও আহতদের উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়- সেখানে তখনও তাজা রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মাথার মগজ, কারোর হাত পা, স্যান্ডেল, জামা কামড়, বেলুন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। শত শত লোক সেখানে ভিড় জমিয়ে বেলুনওয়ালার কান্ডজ্ঞানহীন ব্যবসা নিয়ে সমালোচনা করছে। বেলুনওয়ালার শিশু ছেলেটারও পরিণতি একই হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী অপর এক অভিভাবক জানান- মনিপুর স্কুল এলাকায় একজন বিক্রেতা সিলিন্ডার দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করছিলেন। সিলিন্ডার দিয়ে বেলুন ফুলানোর সময় এটির বিস্ফোরণ ঘটে। রূপনগর থানার ডিউটি অফিসার জানান, পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেছেন।
এদিকে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান। বুধবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছে। নিহতদের নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মোঃ রাসেল বলেন, রূপনগরের গ্যাস সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। এটি বাসা-বাড়িতে ব্যবহারের সিলিন্ডার নয়। বেলুন ফোলানোর জন্য যে গ্যাস ব্যবহার করা হয়, সেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে গিয়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধার করে। এ ছাড়া একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয়রা কয়েকজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
এদিকে জরুরী সেবা ৯৯৯ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন পেয়েই ঢাকা মহানগর এ্যাম্বুলেন্স এ্যাসোসিয়েশনের যে কর্মকর্তা রূপনগরে ছুটে গিয়েছিলেন, সেই প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তা হাসপাতালের বীভৎস দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সাংবাদিকদের। তিনি জানান- সেই করুণ দৃশ্য বলার মতো নয়। তারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। কারও চেহারা ঝলছে গেছে। ছোপ ছোপ কালচে তাজা রক্ত রাস্তায় গড়াচ্ছে। আনুমানিক ৬-১৪ বছর বয়সী ১০-১২ জন ক্ষুদে শিশু মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। উফ! বীভৎস ও মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে বুক আঁতকে ওঠে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, বিস্ফোরণে নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়। এ চারজনের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। যে দুজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তারা বিপন্মুক্ত।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসাধীন এক মেয়ে শিশুর কাছে গণমাধ্যমকর্মীরা বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তার চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক তাকায়। তারপর সে বলে- বেলুন কিনতে সেখানে গেলেও একটু দূরে ছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনে এবং কয়েকজন সমবয়সীর চিৎকার শুনতে পাই। তার পায়ের আঙুলে ভীষণ ব্যথা করছে বলে সে কান্নাজুড়ে দেয়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিহত এক শিশুর খালা জানান, তার বোনের মেয়ে বাবার কাছে বেলুন কেনার বায়না ধরলে তার বাবা তাকে টাকা দিয়ে বেলুন কিনতে পাঠান। কিছুক্ষণ পরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এসে মেয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
বিস্ফোরণের খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়াতে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন।