কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। রাজনৈতিক দলিলে দ্বিমত পোষণ করে বিকল্প প্রস্তাবও এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে থাকা, না থাকা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই এই মতপার্থক্য চলে আসছে। কংগ্রেসকে সামনে রেখে এই মতপার্থক্য দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। এছাড়া পার্টিতে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নেতাকর্মীদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তাদের অভিযোগ, একটি কমিউনিস্ট আদর্শভিত্তিক পার্টির যে রাজনৈতিক চরিত্র থাকা উচিত ওয়ার্কার্স পার্টি তা থেকে অনেকটাই সরে গেছে।
আগামী ২ নভেম্বর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির চার দিনব্যাপী দশম কংগ্রেস (কেন্দ্রীয় সম্মেলন) শুরু হবে। এই কংগ্রেসে পার্টির যে রাজনৈতিক দলিলের সঙ্গে দ্বিমত করে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন পলিট ব্যুরোর সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদ।
এই বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পার্টি আজ অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম কংগ্রেসে বাম ও দক্ষিণপন্থি বিচ্যুতির সুনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশগুলো চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে মতাদর্শিক সংগ্রাম করার কথা বলা হয়েছিল। সে কাজটি একেবারেই অবহেলিত ও গুরুত্বহীন থেকেছে। ফলে মতাদর্শিক শূন্যতার স্থান বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া মতাদর্শ পূরণ করেছে, আধিপত্য বিস্তার করেছে।
প্রস্তাবে পার্টির এই দুই শীর্ষ নেতা বলেন, পার্টিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হয়েছে। পার্টির রণনীতির স্থলে বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি স্থান পেয়েছে, সুবিধাবাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণীর সরকারের অংশ হিসেবে পার্টি নেতৃত্বকে রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধাভোগী করে তোলার কাজ সুনিপুণভাবে করা হচ্ছে। ফলে পার্টির উচ্চস্তরে গড়ে উঠেছে একটি সুবিধাভোগী চক্র।
এতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব অর্জনের বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণা ও কর্মকৌশল সর্বক্ষেত্রে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক সময় সিপিবি বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি এবং পার্টি এখন ১৪ দলের হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে ও সরকারে অংশ নিয়ে বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তির নজির স্থাপন করেছে। তার ফল হিসেবে বিপ্লবী রাজনীতি তো নয়-ই পার্টি বরং বিলোপবাদী ও জনস্বার্থ পরিপন্থি হয়ে গণআকাক্সক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১৪ দলের নীতিনির্ধারণে শরিকদের ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ নেই। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন ও সরকারে অংশগ্রহণের ফলে সবক্ষেত্রে পার্টিকে আওয়ামী লীগের শোষণ লুণ্ঠন, গণবিরোধী কর্মকাণ্ড নীরবে হজম করতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু গরম গরম কথা বলে জনগণ ও পার্টি কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, আমি ও নুরুল হাসান বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। পার্টিতে মতাদর্শগত কিছু পার্থক্যের কারণে আমরা দলিলে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি।
তবে এই প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাননি।
এদিকে ওয়ার্কার্স পাটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টির নতুন সদস্য করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পার্টি সদস্য বাড়ানোর জন্য গঠনতন্ত্রের নিয়ম উপেক্ষা করে সদস্য করা হচ্ছে। পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে কংগ্রেসে জোরালো মত তৈরি করার জন্য এটা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়াং মেনস ক্লাবে অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তখনই সেখানে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি সামনে আসে। এই ক্লাবের চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ক্লাবটি উদ্বোধনও করেছিলেন তিনি। এরপর থেকে নানা মহলে সমালোচিত হচ্ছেন মেনন।
যদিও মেনন দাবি করেন, উদ্বোধনের দিন একবারই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তারপরও বিষয়টি নিয়ে পার্টির কিছু নেতাকর্মী প্রশ্ন তুলছেন, তিনি (মেনন) কেন বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেননি।
এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদে রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খানকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) করা নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে আপত্তি রয়েছে।
তাদের অভিযোগ, লুৎফুন্নেছা খান পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। পার্টিতে আলোচনা না করে তাকে এমপি করা হয়েছে।
আসন্ন কংগ্রেসকে সামনে রেখেই মূলত এসব বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে। দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পার্টির আভ্যন্তরীণ এই বিষয়গুলোর নেতিবাচক প্রভাব জেলা সম্মেলনেও পড়েছে। বগুড়ায় দুইটি জেলা কমিটি হয়েছে।
নড়াইলে আলাদা দুইটি সম্মেলন হয়েছে। ঝালকাঠি, পিরোজপুর, মাদারীপুর, যশোরসহ আরও কয়েকটি জেলায় সমস্যা চলছে। এরই মাঝে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, পার্টির পলিট ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সদস্যসহ সাবেক ছাত্র নেতাদের অনেকেই কংগ্রেসে যোগ দেবেন না।
তবে এসব নিয়ে কথা বলতে চাইলেও বিষয়গুলোকে খুব গুরুত্ব দেননি ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, ছোটখাটো সমস্যা থাকতে পারে, ভিন্নমতও থাকতে পারে। কিন্তু সেটা বিকল্প দলিল বলা যায় না। এখন পর্যন্ত পার্টিতে কোনো সমস্যা নেই। সব কিছু ঠিক করবে কংগ্রেস।
‘ভোটের মাধ্যমে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। কংগ্রেসে পার্টির কোনো নেতা অংশ নেবে না এরকম কিছু দেখছি না। আমি পার্টির সবার সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ আমাকে বলেননি কংগ্রেসে আসবেন না।’
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, সদস্য করার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়ম আছে, সেটা অনুসরণ করেই পার্টির নতুন সদস্য করা হয়। পার্টিতে কিছু নেগেটিভ লোক থাকে যারা এসব নেগেটিভ কথা ছড়িয়ে বেড়ায়। তবে যা-ই হবে সেটা কংগ্রেসে হবে।