কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘র্যাগিং কালচার’ নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে র্যাগিং বন্ধ করার সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদনেও হত্যাকান্ডের কারণগুলোর মধ্যে একটি কারণ উল্লেখ থাকবে র্যাগিং। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে র্যাগিং হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি বদনাম কুড়িয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেমন র্যাগিং হয় তার প্রতিবেদন তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজে বেশি র্যাগিং হয়। শুধু ছাত্ররাই নয়, র্যাগিংয়ের শিকার হন ছাত্রীরাও। এমনকি র্যাগিংয়ের নামে নির্দয়, নিষ্ঠুর নির্যাতন ছাড়াও অশ্লীল, অসামাজিক কার্যকলাপ পর্যন্ত ঘটেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ২০১৮ সালে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিংয়ের ওপর জরিপ পরিচালনা করে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার জরিপের বিষয়বস্তু ছিল র্যাগিংয়ের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৮৪ ভাগ শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের শিকার হয়েও তারা কোন অভিযোগ জানায়নি। শতকরা ৫৬ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছিল, র্যাগিং তাদের ভবিষ্যত জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছে, র্যাগিং খুবই নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক। তবে বড়দের ভয়ে ছোটরা র্যাগিংয়ের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী। তবে র্যাগিংয়ের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলেও ফৌজদারি আইনে কোন সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা অনুপস্থিত। কেবলমাত্র কোন শিক্ষার্থীর র্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার খবর নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে, তখন অভিযুক্তদের বহিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায়িত্ব সারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত র্যাগিংকে একটি শাস্তিযাগ্য অপরাধের আওতায় আনা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত র্যাগিং পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে না। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের পর আবারও সামনে চলে এসেছে র্যাগিং বিষয়টি।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি প্রথা সেটাকেই র্যাগিং বলে অভিহিত করা হলেও তা দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রসিকতার ছলে র্যাগিংয়ের নামে যে প্রথা চলছে, তা এক কথায় টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে প্রথম পা রেখেই র্যাগিং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ে এ অবস্থা চরম নাজুক। এ নির্যাতনে পেছিয়ে নেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত সরকারী কলেজগুলোও। র্যাগিংয়ের মাধ্যমে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। যেভাবে র্যাগিং করানো হয় তার মধ্যে আছে, কান ধরে ওঠবস করানো, রড দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, ব্যাঙ দৌড়ে বাধ্য করা, সিগারেট-গাঁজা-মদ্যপানে বাধ্য করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করানো, সবার সম্মুখে নগ্ন করে নাচানো, যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, ছেলেমেয়ে হাত ধরা বা জোর করে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করা, অপরিচিত মেয়ে অথবা ছেলেকে প্রকাশ্যে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যৌন হয়রানি করা, দিগম্বর করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম অথবা মাঠের মাপ নেয়া, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাপ নেয়া, শীতের মধ্যে পানিতে নামিয়ে নির্যাতন করা, পুরোনো শিক্ষার্থীদের থুতু মাটিতে ফেলে নতুনদের তা চাটতে বলা, বড় ভাইদের পা ধরে সালাম করা, গালাগাল করা, নজরদারি করা, নিয়মিত খবরদারি করার মতো নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মাকা-। র্যাগিংয়ের মতো অপদস্থ ও নির্যাতনমূলক আচরণে অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে অনেকে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে। তাছাড়া আজ যে শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আগামীতে এর চেয়ে বেশি মাত্রায় র্যাগিং করার পরিকল্পনা করবে এবং নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর চড়াও হবে- এটাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের ঘটনায়ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস, শিবির কর্মী ইত্যাদির যেসব অভিযোগ উঠেছে তার মধ্যে অভিভাবকত্বের বা সিনিয়রিটির অধিকার ও দাবি নিয়ে র্যাগিং বিষয়টিও কাজে লাগিয়েছে হত্যাকারী ছাত্ররা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে র্যাগিং সংস্কৃতি বা কালচার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর র্যাগিং যেই কলুষিত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির বড় ভূমিকা রয়েছে। র্যাগিংয়ে যারা নেতৃত্ব দেয়, তাদের অধিকাংশ কিন্তু শুধু সিনিয়র বড় ভাইয়া বা আপু তো বটেই, তাদের আরও বড় একটি পরিচয় আছে, তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্য। এর ফলে র্যাগিং প্রতিহত করা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি দুরূহ হয়ে পড়েছে। যারা র্যাগিং করে, তারা আবার ছাত্র রাজনীতিও করে। তাই তারা নিজেদের অনেক ক্ষমতাবান মনে করে। যারা র্যাগিং করে তারা চিন্তা করে, আমাদের পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের ‘ব্যাক আপ’ রয়েছে, তাই আমরা যা-খুশি-তাই করতে পারি। এই ধরনের মানসিকতা থেকেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে র্যাগিং বিষয়টাকে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর্যায়ে এনে দিয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থীদের এই বিশেষ র্যাগিংয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে নিহিত আছে অনেক মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং এতই বৃদ্ধি পায় যে শেষ পর্যন্ত র্যাগিংবিরোধী র্যালি বের করা হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে র্যাগিং বন্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ‘র্যাগিংমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়বো, সকলে মিলে সৌন্দর্যপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করবো’ স্লোগানে সচেতনতা বাড়াতে বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। র্যালিতে নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। কিন্তু ৬ মাস না যেতেই গত আগস্ট মাসে আবারও র্যাগিংয়ের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায় যে, শারীরিক নির্যাতন, মুক্তিপণ দাবি, যৌন হয়রানি ও র্যাগিংয়ের পৃথক ছয় ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দুই ছাত্রীসহ মোট ১৮ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বহিষ্কৃতদের মধ্যে দু’জনকে জরিমানাও করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বাসায় ফেরত গেছে। দেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে র্যাগিং হয় তার মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বেশি হচ্ছে। র্যাগিংয়ের ভয়াবহতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হতে পারে সমাজে নতুন এক ব্যাধি ধীরে ধীরে কঠিন আকার ধারণ করছে। এ বছর রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে আর শাহজালালের ছয়জন শিক্ষার্থী হয়তো কোনভাবে আমার মতো র্যাগিং খাওয়ার পরও টিকে গেছে। বিশেষ করে ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইডেন কলেজে র্যাগিংয়ের নামে এমন অশ্লীল ও অসামাজিক কার্যকলাপ ঘটে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।
বুয়েট মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ শুধু নিজের মত প্রকাশ করায় নির্মমভাবে খুন হওয়ার পেছনে কারণ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বা বুলিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার মানসিকতা কাজ করেছে। বিনা দোষে, বিনা অপরাধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগত একজন নবীন ও নতুন শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের নামে যে ধরনের নিষ্ঠুর ও নির্দয় নির্যাতন করা হয় তা ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আবরার ফাহাত হত্যাকা-ের তদন্ত প্রতিবেদনেও র্যাগিং বন্ধে বা নিষিদ্ধ করার সুপারিশ উল্লেখ থাকবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বস্তির নিশ্বাস বয়ে আনতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।