বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ ॥ আবরার হত্যায় এজাহারভুক্ত ১৯ ছাত্র সাময়িক বহিষ্কার

29
বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার বক্তব্য রাখছেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্র- শিক্ষকের সব ধরনের সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ততায় এজাহারভুক্ত ১৯ ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম শুক্রবার বিকেলে ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন। বলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।
বুয়েট অডিটোরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি আরও বলেন, আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। মামলার খরচ বুয়েট কর্তৃপক্ষ বহন করবে। বিচার কাজ দ্রুত শেষ করতে সরকারকে চিঠি দেয়া হবে। বুয়েটে র‌্যাগিং বন্ধ হবে। উপাচার্য এ বিষয়ে নিজের ক্ষমতাবলে ছাত্র-শিক্ষক রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বলেন, এখন থেকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভিসির এই সিদ্ধান্তকে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ভিসি তার ভুল স্বীকার করে শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমাও চান। আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনায় সবার মতো তিনি ব্যথিত ও মর্মাহত বলে উল্লেখ করেন।
উপাচার্য বলেন, ক্যাম্পাসে এবং হলে ছাত্ররা যাতে এই ধরনের নির্যাতনের শিকার না হয় এজন্য একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে তোলা হবে, যেখানে পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানাতে পারবে। কারও বিরুদ্ধে নির্যাতনের কোন অভিযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ব্যবস্থা নেবে। হলগুলোয় র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতনের বিষয়ে দ্রুততম সময়ে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসের মধ্যে সিসিটিভি বসানো হবে। এ জন্য সময়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
আবরার ফাহাদের হত্যার দ্রুততম বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। এ বিষয়ে সরকার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন উপাচার্য। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ১৯ ছাত্রকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর স্থায়ীভাবে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার শুরুতেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আবরারের খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবির প্রেক্ষিতে উপাচার্য বলেন, আমরা এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সিসিটিভির ফুটেজ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়েও সরকার আমাদের আশ্বস্ত করেছে।
শুক্রবার বিকেল ৫টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধসহ ১০ দফা দাবিনামা পেশ করেন। বক্তব্যের শুরুতেই নিজের ভুলের বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে উপাচার্য বলেন, আমার কিছুটা ভুল হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার ভুল আমি স্বীকার করেছি, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আবরার আমার সন্তানের মতো ছিল। তোমাদের যেমন কষ্ট লাগছে তার মৃত্যুতে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে। এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। তার মৃত্যুতে দুঃখ তোমরা পেয়েছে, আমিও পেয়েছি; সকলেই মর্মাহত।
শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৫টায় বুয়েট অডিটরিয়ামে ফাহাদ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠক শুরু হয়। এতে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইয়াজ হোসেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মাসুদসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের শুরুতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি ও আবরার হত্যার ঘটনায় উঠে আসা ইস্যু নিয়ে উপাচার্যের কাছে জবাব চাওয়া হয়। এর আগে আলোচনায় অংশ নিতে শিক্ষার্থীরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে সারিবদ্ধভাবে অডিটরিয়ামে প্রবেশ করেন। সাংবাদিকদের প্রবেশের জন্য প্রেসকার্ড ইস্যু করা হয় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।
আগেরদিন বৃহস্পতিবার এসব শিক্ষার্থী আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন, উপাচার্য যদি শুক্রবার বেলা ২টার মধ্যে তাদের সঙ্গে দেখা করে দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন না করেন তাহলে বুয়েটের সব ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবারই উপাচার্যের পক্ষ থেকে আলোচনায় বসার কথা জানানো হয়। শুক্রবার বৈঠকে রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করেন তিনি।
এ সময় হত্যাকান্ডের পর ক্যাম্পাসে উপস্থিত না হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, বুয়েটে কোন ঘটনার পরে এত দ্রুত সময়ে অপরাধীদের গ্রেফতার হয়েছে, আগে এমন রেকর্ড নেই। সেদিন সকালে প্রশাসনের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছি। তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সরকার, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে। তাছাড়া আবরারের মামা এসেছিল। তার দেয়া তথ্য মতে আমি জানতাম যে লাশ হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। বুয়েটে যে জানাজা হবে এই তথ্য আমি জানতে পারিনি।
ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে রবিবার (৬ অক্টোবর) রাত ৮টায় ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী। তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে রাতভর বেদম প্রহার করা হয়। প্রচন্ড আঘাতের কারণে আবরারের অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডরে নিয়ে রাখা হয়। পরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত বলে ঘোষণা দেন। ৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বলেন, আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। তাকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গার নিজ গ্রামে সমাহিত করা হয়েছে।
আবরার হত্যাকান্ডের পর থেকেই এই হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে আন্দোলন দানা বেধে ওঠে। হত্যার বিচার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সকাল থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সকালে তারা এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে মিছিল ও পথনাটকসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। অবশ্য উপাচার্য ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের দেয়া ১০ টি দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বুয়েটের শহীদ মিনার এলাকায় জড়ো হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে বেলা ১১টায় সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিল শেষে শহীদ মিনারের সামনের চত্ব¡রে বসে স্লোগান দেন তারা। বেলা ২টায় শহীদ চত্বরে টকশোর আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা। আলোচনার শুরুতে আবরার ফাহাদের স্মরণে উপস্থিত সকলে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।