কাজিরবাজার ডেস্ক :
মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও আজীবন ছাত্রত্ব বাতিল, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসহ সাত দফা দাবিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) উত্তাল। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে মঙ্গলবার সকাল থেকেই বুয়েট ক্যাম্পাস ছিল অশান্ত। দুদিনেও উপাচার্য প্রকাশ্যে না আসায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে দীর্ঘদিন পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি সামনে চলে এসেছে। দাবিতে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন ছাত্র কল্যাণ পরিচালকও। দিনভর প্রতিবাদ হয়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। আবরার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও।
এদিকে প্রায় দুদিন পর শিক্ষার্থীদের সামনে এসে উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইমলাম ‘দাবি মেনে নিয়েছি’ বলে ঘোষণা দিলেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে শিক্ষকদের সহায়তায় ক্যাম্পাস ছাড়েন উপাচার্য। এর আগে সোমবার রাতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করলেও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি না হওয়া, উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীদের সামনে না আসায় মঙ্গলবার সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা সকালেই ঘোষণা করেন, বেলা তিনটা থেকে পলাশী মোড় বন্ধ করে অবস্থান নেয়া হবে। পরে বিজয়া দশমীর কর্মসূচীর কারণে পিছিয়ে দেয়া হয়। তবে সকাল সাড়ে ৮টা থেকেই বুয়েট শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ঘোষণা দেয়া হয় উপাচার্য প্রকাশ্যে সামনে এসে জবাবদিহিতা না করা পর্যন্ত সকল ক্লাস, পরীক্ষা এমনকি নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়া হবে। সকাল থেকেই শত শত শিক্ষার্থী প্রতিবাদ বিক্ষোভ থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষার্থীদের খুন করা হচ্ছে। এটা কোনমতেই কাম্য নয়। আমরা ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানাই।
সকাল সাড়ে ১০টায় বুয়েট ক্যাফেটারিয়ার সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বুয়েটের বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান দেন। আন্দোলনকারীরা জানান, যতক্ষণ না ভিসি সশরীরে এসে তাদের ৭ দফা দাবি মেনে নেবেন, ততক্ষণ শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান করবেন তারা। এ সময় ৭ দফা দাবি ঘোষণা করে তা মানা না হলে, বুধবার (আজ) থেকে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের সাত দফা : শিক্ষার্থীদের সাত দফা দাবি হলো খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শনাক্তকৃত খুনীদের সকলের ছাত্রত্ব আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে। দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি তা তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে। একই সঙ্গে ডিএসডব্লিউ স্যার কেন ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করেছেন তা উনাকে মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে সকলের সামনে জবাবদিহি করতে হবে। আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সকল প্রকার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনকে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লাহ হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল আগামী ১১ নভেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ নভেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। মামলা চলাকালীন সকল খরচ এবং আবরারের পরিবারের সকল ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে।
দাবির সঙ্গে একমত শিক্ষকরাও : দাবি ঘোষণার পরই তাদের এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, আমার মনে হয় না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির কোন প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। বুয়েটেও নিষিদ্ধ করা উচিত। কবে নিষিদ্ধ করা হবেÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে বসে লিখে দিলে কিংবা বলে দিয়ে হয়ে যাবে না। তবে এসব বিষয় নিয়ে বুয়েটের ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব কথা বলবেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রকল্যাণ পরিচালক। সকালে আন্দোলনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কাছে যান ছাত্র কল্যাণ পরিচালক। এ সময় তাকে ঘিরে ধরেন শিক্ষার্থীরা। তার কাছে শিক্ষার্থীরা তখন নানা ধরনের ক্ষোভ জানাতে থাকেন। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
ছাত্র কল্যাণ পরিচালক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থলে বক্তব্য দেয়ার সময় শিক্ষার্থীর তার কাছেও জানতে চান, উপাচার্য কেন ঘটনাস্থলে আসেননি। এ সময় উপাচার্যের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তারা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ছাত্র কল্যাণ পরিচালক উপাচার্যের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ধরেননি। এতে শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা প্রশাসনের নামে নানা ধরনের শ্লোগান দেন।
শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি জানিয়েছেন, এর সঙ্গে তিনি একমত। তবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ক্ষমতা তো তার হাতে নেই। সে জন্য তিনি এ দাবিটি পূরণে সহযোগিতা করবেন। তার পক্ষ থেকে যতটুকু করার, তিনি তা করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল মিছিল করে এসে বেলা পৌনে ১২টার দিকে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পরে বুয়েট শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিরাও সমাবেশস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এ সময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, তারাও চান ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। বাবা-মা শিক্ষার্থীদের আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, কিন্তু আমরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে একমত। একাডেমিক ভবন, হলসহ সমগ্র ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনা প্রমাণ করছে যে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ কর্মসূচীতে এসে বলেন, আমাদের এক ছাত্রকে এভাবে পিটিয়ে মারা হলো… আমাদেরও অনেকের এই বয়সী সন্তান আছে। আমরা আমাদের নিজের সন্তানদের মতো করে বিষয়টিকে ফিল করছি। আবরার ফাহাদের কথা বলতে গিয়ে অনেক শিক্ষক কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। এই হলো এখন আমাদের অবস্থা। অতীতের বিভিন্ন র্যাগিংয়ের ঘটনায় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় আবরারকে প্রাণ দিতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে এই শিক্ষক নেতা বলেন, একটা ছেলেকে এভাবে পিটিয়ে মারা হবে, এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। খুনীরা আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে, আমরা সবাই এটা চাই। আমরা চাইব, আবরার হত্যার বিচার হবে এবং বুয়েট তার সুনাম অক্ষুণœ রেখে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। একাডেমিক ভবন, হলসহ সমগ্র ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
এদিকে বুয়েট ক্যাম্পাস ছাড়াও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বুয়েট শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মিছিল বের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও। বেলা পৌনে একটার দিকে তারা শহীদ মিনার থেকে মিছিল বের করে পলাশী হয়ে জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মোড় হয়ে পূর্ব পাশের গেট দিয়ে এখন আবার বুয়েট ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন।
এ সময় শত শত শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় দাবি না মানলে ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য ভর্তি পরীক্ষা আটকে দেয়ার হুমকি দেন। তারা বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমাদের আট দফা দাবি না মানা হবে, ততদিন বুয়েটের সব একাডেমিক কার্যক্রম ও ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
৩৬ ঘণ্টা পর প্রকাশ্যে উপাচার্য, দাবি মেনে নেয়া হবে বললেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি : আবরার ফাহাদের খুনীদের বিচারসহ ৭ দফা দাবিতে আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীরা বিকেল পাঁচটা দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। প্রায় দুই দিন পর উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ওই ভবনের দোতলায় নিজের কার্যালয় আসেন, তবে তিনি বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সামনে আসেননি। এ সময় শত শত শিক্ষার্থীর ওই অবস্থান থেকে স্লোগান উঠছে- ‘ভিসি স্যার নীরব কেন, জবাব চাই দিতে হবে’, ‘আমার ভাই কবরে, ভিসি কেন ভেতরে’, ‘প্রশাসন নীরব কেন, জবাব চাই দিতে হবে’। সেই সঙ্গে চলতে তাদের মূল স্লোগান- ‘আবরারের খুনীদের, ফাঁসি চাই দিতে হবে’।
শিক্ষার্থীরা জানান, ভিসি স্যারের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা আছে, স্যার চাইলে যে কোন সময় আমরা বসতে রাজি আছি। স্যার আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিলে আমরা আন্দোলন ছেড়ে ক্লাসে যাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ডিনদের সঙ্গে গোপনে বৈঠকে যোগ দেন ভিসি। এ খবর পেয়েই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপ ভিসি ভবনের মূল ফটকের কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন।
শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হলেও সব ক্ষমতা নিজের হাতে নেই বলে জানান উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম। আন্দোলকারী শিক্ষার্থীদের তিনি বলেছেন, আবরার হত্যায় জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে বহিষ্কার করা হবে। আমি শিক্ষা-উপমন্ত্রীর সঙ্গে তোমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছি। তোমাদের দাবিগুলোর সঙ্গে নীতিগতভাবে আমরা একমত। তবে আমার হাতে সব ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা অনুযায়ী তোমাদের দাবিগুলো মেনে নেব। হত্যায় জড়িতদের বহিষ্কার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি তোমাদের অভিভাবক, তোমরা আমার সন্তান। আবরারের সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা অনাকাক্সিক্ষত। এ কথা শোনার পর শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা ভিসিকে বলেন, ‘এটা একটা খুন, আপনাকে স্বীকার করতে হবে।
এ সময় শিক্ষার্থীদের শান্ত হয়ে কথা শুনতে বলেন ভিসি সাইফুল ইসলাম। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শান্ত হলে ভিসি বলেন, আমি শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা দেশের বাইরে আছেন। সেখান থেকে তারা যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন আমি তা পালন করছি। আমি তোমাদের দাবিগুলো দেখেছি। এসব নিয়ে তোমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি সব দাবি মেনে নিয়েছি।
এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী উত্তেজিত হয়ে ভিসিকে বলেন, আবরার খুন হওয়ার পর আপনি কই ছিলেন? গতকাল কেন এখানে আসেননি? ভিসি বলেন, আমি এখানেই ছিলাম। আমি গত রাত দেড়টা পর্যন্ত কাজ করেছি। এই বলে ভিসি চলে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর শিক্ষার্থীরা ভিসি ভবনের নিচে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ভিসির সঙ্গে বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। অবরুদ্ধ অবস্থায় ভিসিকে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
তখন ভিসি বলেন, আমি তোমাদের কাছে এভাবে জবাবদিহি করব না। তোমরা কয়েকজন আসো, আমি আলোচনা করব। এটা বলার পর ‘শেম শেম’, ‘মানি না, মানি না’ বলে বিক্ষোভ করতে থাকেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে নানাভাবে বুঝিয়ে উপস্থিত শিক্ষক ও ডিনদের নিয়ে চলে যান ভিসি সাইফুল ইসলাম। ঢাবিতে গায়েবানা জানাযা, কফিন মিছিল : আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে গায়েবানা জানাযা ও কফিন মিছিল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে এই গায়েবানা জানাযায় নেতৃত্ব দেন ডাকসুর সমাজ সেবা সম্পাদক আকতার হোসেন। পরে প্রতীকী কফিন নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল মিছিল বুয়েটে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বর, পলাশী হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে সেই কফিন মিছিল। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর বকশীবাজার হয়ে আবার টিএসসির দিকে ফেরেন তারা।
গায়েবানা জানাযার পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তির বিরোধিতা করায় আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। আবরারের রক্তস্নাত দেশবিরোধী চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আবরারকে হত্যার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বাধা দিয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ছাত্র সমাজকে বলব, প্রত্যেকটা ছাত্র, যে যেখানে বিপদে পড়ুক, আপনারা পাশে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন।
পরে কফিন মিছিল থেকে ‘ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল কর, করতে হবে’, ‘আবরারের খুনীদের, ফাঁসি চাই দিতে হবে’, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা, হুঁশিয়ারÑ সাবধান’, ‘ছাত্রলীগের গুন্ডারা, হুঁশিয়ার-সাবধান’, ‘বুয়েট তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে শোনা যায়। ভিপি নূর দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মেধা অনুযায়ী সিট বরাদ্দ দেয়া এবং গণরুম, গেস্টরুম ‘কালচার’ বন্ধেরও দাবি জানান।
এ হত্যাকান্ড নির্মম ও পৈশাচিক : ঢাবি শিক্ষক সমিতি : আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতি। সমিতি সভাপতি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল ও যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. তাজিন আজিজ চৌধুরী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়। এতে বলা হয়, নৃশংস এ হত্যাকান্ডে আমরা ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও মর্মাহত। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা। এই হত্যাকান্ড নির্মম ও পৈশাচিক। আমরা আবরারের হত্যাকারীদের দ্রুততম সময়ে বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
শিক্ষক সমিতি আরও বলেছে, জ্ঞানচর্চা ও বিতরণই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও পরমসহিষ্ণুতা ব্যাহত হলে বিশ্ববিদ্যালয় তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আবরারের এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীর চরম অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ; যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী।
শিক্ষক নেতারা আরও বলেন, দুঃখের বিষয় এই যে গত কয়েক দশকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অসহিষ্ণুতার চর্চা চলছে। সমাজপরিসরে বিদ্যমান নীতিহীনতা, বিবেকশূন্যতা ও চিন্তাজগতের আড়ষ্টতা আমাদের এক অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান এ পরিস্থিতির প্রতিকার না হলে জাতি হিসেবে আমরা অন্তঃসারশূন্য ও দেউলিয়া হয়ে পড়ব।
আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামীর বাংলাদেশ। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা- যেমনটি ছিল আবরারেরও। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর চিন্তার জগতে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত না করা গেলে এবং শিক্ষাঙ্গনে সহিষ্ণু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা দায়বদ্ধ থাকব। সব রাজনীতিবিদ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং নাগরিক সমাজসহ সবার কাছে আমাদের উদাত্ত আহ্বান- আসুন, আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে শিক্ষাঙ্গনকে প্রকৃত মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করি এবং সবাই মিলে শিক্ষাঙ্গনে সহিষ্ণু পরিবেশ সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ নিই।
আরও বলা হয়, আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক শিক্ষাবান্ধব, নিরাপদ ও মানবিক। প্রধানমন্ত্রী আবরারের হত্যাকারীদের অতিদ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা প্রত্যাশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এই হত্যাকা-ের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে।
ভারতের সমালোচনার সঙ্গে আবরার হত্যাকান্ডের সম্পর্ক নেই : শিক্ষা উপমন্ত্রী : আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি নিজ ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেন তিনি। বলেন, বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িত সন্দেহে ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়জন ছাত্রকে আটক ও গ্রেফতার করা হয়েছে। আইন অবশ্যই তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বুয়েট কর্তৃপক্ষও তদন্ত করছে মূল ঘটনা উদঘাটনে এবং সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে জড়িত সকলেই যাতে বিচারের মুখোমুখি হয়। এ নির্মম ঘটনাকে নিয়ে বিএনপির মহাসচিব একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেষ্টা করছেন।
ভারতের সমালোচনার সঙ্গে এ হত্যাকান্ডের কোন সম্পর্ক নেই। আবরার তার মত প্রকাশ করেছে আর অপরাধীরা অপরাধ করেছে। সবকিছুতে ভারতবিরোধী কথা বলে ঘোলা পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করবেন না। নিজেরা সাম্প্রদায়িক বলে সব কিছু সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখবেন না। সন্দেহভাজন অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে, বিচার হবে, দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি হবে। এইটা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ এখন, এখানে জজ মিয়া নাটকের যবনিকাপাত হয়েছে। তাই আস্থা রাখুন, অপরাধীরা ছাড় পাবে না।
শিক্ষার্থীদের পাশে ছাত্র শিবিরও : আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা এবং অবিলম্বে খুনীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্রশিবির। এক যৌথ বার্তায় ছাত্রশিবিরের সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন ও সেক্রেটারি জেনারেল সিরাজুল ইসলাম, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণ ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
তারা বলেন, বিচারহীনতার কারণেই সন্ত্রাসী খুনী ছাত্রলীগের বীভৎস রূপ জাতিকে আরেকবার দেখতে হলো। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রবিবার রাত ৮টার দিকে বুয়েটের নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবরারকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে।
সাম্প্রদায়িক উসকানি, ভুয়া ছবি ও ভিডিও : বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের দশ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়েছে পুুলিশ। আরও তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ১১ জনকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ সরকারের অনেকেই।
হত্যাকান্ডে সন্দেহভাজন অনেককে নজরদারির মধ্যে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এরই মধ্যে ভুয়া ভিডিও ভাইরাল করছে বিশেষ সেই কুচক্রী মহল। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাত/আটজন মিলে একজন লোকের হাত পা ধরে রেখেছে আর দুইজন লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। ভিডিওটি ভারতের এবং কয়েক বছরের পুরনো বলে জানা গেছে। আবারের ছবি হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে বুকে-পিঠে মারের দাগওয়ালা অন্য একজনের ছবি।
বাস্তবে ওই ছবিটি আবরারের নয়। এখানেই শেষ নয়। ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহাকেও গ্রেফতারের দাবির আড়ালে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ফেসবুক পেজে এই দাবি তোলেন তিনি। সেখানে সাম্প্রদায়িক উসকানি থাকার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া শিবিরের বাশেরকেল্লা থেকেও নানা রকমের উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসিফ নজরুল লিখেছেন, আমত শাহা হিন্দু বলে তাকে গ্রেফতারের দাবি করা যাবে না? এ দাবি করাটা যারা সাম্প্রদায়িকতা বলেন তারাই আসলে সাম্প্রদায়িক। আসিফ নজরুল সাম্প্রদায়িক কথা বলে কৌশলে পরে নিজের চেহারা লুকানোর চেষ্টাও করেন পরের বক্তব্যে। বলেন, তবে অমিত অন্যতম অভিযুক্ত খুনী বলে ঢালাওভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বলা অনুচিত। সেটা করাও হবে সাম্প্রদায়িক।