কাজিরবাজার ডেস্ক :
সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও নিষ্পত্তি করা হয় সরকারি চাকরি আইনের (শৃঙ্খলা ও আপিল) নিয়ম অনুযায়ী। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ কথা জানালেও সম্প্রতি শীর্ষপর্যায়ের কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে রাজি হননি তারা। যদিও এই সময়ে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় একাধিকবার যোগাযোগ করেও বিস্তারিত কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা জানান, অভিযোগ ওঠা কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় পুলিশ সদর দফতর। তবে অভিযোগ আসার পরপরই অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গা থেকে প্রথমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই নিয়ম এএসপি থেকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও মানা হয়। তবে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কর্মকর্তারা বলেন, অভিযোগ ওঠার পর সাময়িক বরখাস্ত যে কেউ হতে পারেন। তবে আপিলে যদি অভিযোগ খণ্ডন করতে পারেন চাকরিতে নিয়মিত হন। অন্যথায় চূড়ান্তভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে কেউ সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী সুবিধা পেয়ে থাকেন। কাউকে সুবিধা ছাড়াই বাড়ি যেতে হয়। আর ফৌজদারি অপরাধ করলে তাকে প্রচলিত আইনে সাজা ভোগ করতে হয়।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে ১ লাখ ২০ হাজার ১৯১টি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারা সবাই কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ঘুষ, নানাভাবে হয়রানি, বিয়ের পর স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ না দেওয়া ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ভুক্তভোগীর মামলা দায়েরের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া, জমিজমা-সংক্রান্তসহ নানা অভিযোগে তাদের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়।
২০১৭ সালে ১৪ হাজার ৬৫৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১১ হাজার সদস্যই কনস্টেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। এই বছর এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব মাত্র ৮ কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড (তিরস্কার, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি) দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের কেউ গুরুদণ্ড পাননি।
২০১৬ সালে ১৩ হাজার ৫০৩ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে লঘুদণ্ড দেওয়া হয় ১২ হাজার ৮৫৮ জনকে। গুরুদণ্ড দেওয়া হয় ৫৬৩ জনকে। বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৭৫ জনকে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে ৭ জনকে। ২০১৬ সালে এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে লঘুদণ্ড, অন্যজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এই গুরুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তি হলেন স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার ঘটনায় আলোচিত এসপি বাবুল আক্তার।
২০১৯ সালে এ পর্যন্ত দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন ডিআইজি মিজানুর রহমান ও এসপি পদমর্যাদার উপ-কমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান। ডিআইজি মিজানকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় কারাগারে পাঠানোর পর তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। একইভাবে পুরান ঢাকায় এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলে সহযোগিতার অভিযোগে লালবাগ জোনের সাবেক ডিসি মো. ইব্রাহিম খানকে গত আগস্টে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পুলিশের মধ্যমসারির এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করে পুলিশ। এতে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে পুলিশ সদর দফতর। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন।
আইন কী বলে
পিআরবি-১৮৬১ (পুলিশ প্রবিধান) অনুযায়ী, কোনও পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে ২ ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতনবৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।
বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগে একটি সেল রয়েছে। সেই সেলের দায়িত্বে রয়েছেন যুগ্ম সচিব এনামুল হাবিব।
পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কীভাবে নিষ্পত্তি করা হয় জানতে চাইলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ-সংক্রান্ত তথ্য দিতেও তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
একই সেলের আপিল কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব সাহেদ আলী। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরি আইনের শৃঙ্খলা ও আপিল রুলস অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। আইনে সবই সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে।’