অপকর্মে জড়িত থাকলে দল পরিবার কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না ॥ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক সম্প্রচার উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

67
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর বাণিজ্যিক সম্প্রচার কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার অঙ্গিকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেনÑ জঙ্গিবাদ সন্ত্রাস মাদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা অভিযান শুরু করেছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে। সে যেই হোক না কেন, এখানে দলমত, আত্মীয়, পরিবার বলে কিছু নেই। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলে দল, পরিবার নির্বিশেষে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারাই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমার হারানোর কিছু নেই। আমি দেশের মানুষের জন্য জীবন বাজি রেখেই কাজ করে যাচ্ছি। সরকার দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ উইপোকায় ধ্বংস করা থেকে রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি জনগণের ‘আত্মবিশ্বাস’ ধরে রাখতে উন্নয়নের তথ্যও সম্প্রচারের জন্য বেসরকারী টেলিভিশন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এমন কিছু করবেন না যাতে এতকিছু পাওয়ার পরও দেশের মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, দিশেহারা হয়ে যায়। যেটুকু ভাল কাজ করেছি অন্তত সেটুকুর প্রচার আমি অবশ্যই দাবি করি। আমি চাইতে পারি সেটা আপনাদের কাছে। গত ১০ বছরে দেশের জন্য কিছু কাজ তো করেছি। এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না। এটাও একটু প্রচার করবেন, যাতে মানুষের ভেতরে একটি বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। তারা যেন আরও সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারেন।
বুধবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বেসরকারী টিভি চ্যানেলের বাণিজ্যিক সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে তিনি এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠান থেকে সুইচ চেপে একযোগে এই সম্প্রচার কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমে দেশের সম্প্রচার শিল্প এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। কারণ, এর ফলে বিদেশী স্যাটেলাইট সংস্থাগুলোকে প্রদত্ত বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সক্ষম হবে দেশী টিভি চ্যানেলগুলো।
সরকার দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ উইপোকায় ধ্বংস করা থেকে রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। প্রকল্প গ্রহণ ও উন্নয়ন বাজেটেও ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছি। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নেয়া বা বাস্তবায়ন করার সময় আমরা মাঝে মাঝে দেখি, উইপোকা খেয়ে ফেলে। এখন এসব উইপোকা ধরা আর সেগুলোকে বিনাশ করার চেষ্টা করছি। জনগণের কষ্টার্জিত প্রতিটি টাকা যেন সঠিকভাবে দেশের উন্নয়নে ব্যয় হয়, তার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি দেশের গরিব মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী কোন ধরনের অপপ্রচার না করার জন্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এসব অপপ্রচার সরকারের বিরোধিতার নামে মানুষের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। আপনারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা- তুলে ধরুন, যাতে দেশবাসীর মনে সরকারের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হয় এবং তারাও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে। আপনারা বিরুদ্ধে বলেন, বিরোধিতা করেন, আমার তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মিথ্যা ও অপপ্রচার যেন না হয় সে ব্যাপারে দয়া করে একটু সতর্ক থাকবেন। অপপ্রচার যে দেশ এবং মানুষের মনে অযথা সন্দেহ বা সংঘাত সৃষ্টি করে সে ধরনের সম্প্রচারের বিষয়ে আপনাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ আমি খুবই আনন্দিত। কারণ, দেশের সব টিভি চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছে। এতদিন আপনারা দেশের বাইরে টাকা পাঠাতেন। এখন আপনাদের অনেক টাকা বেচে গেল। আশা করি, ইলেক্ট্রনিক সম্প্রচার মাধ্যমের আরও অনেক বাধা দূর হবে। পরনির্ভরশীলতা থাকবে না। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলাম। তিনি বলেন, আমরা আশপাশের দেশগুলোর কাছেও অফার করেছি। তারা চাইলেও ভাড়া নিতে পারবে এর ট্রান্সপন্ডার। এখান থেকেও আমরা অর্থ উপার্জন করতে পারব। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সহজে বার্তা পৌঁছানো যাবে। নিজস্ব প্রযুক্তি ও জ্ঞান দিয়ে বাংলাদেশ একদিন মহাকাশ জয় করবে, এটা আমার বিশ্বাস।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস এবং এ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (এটিসিও) চেয়ারম্যান ও মাছরাঙ্গা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএসসিএল) চেয়ারম্যান ড. শাজাহান মাহমুদ অনুষ্ঠানে বাণিজ্যিক সম্প্রচারের জন্য বেসরকারী টিভি চ্যানেল মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে বিসিএসসিএলের সম্পাদিত চুক্তিনামাটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী পরে তা এ্যাটকো চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করেন।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ওপর একটি অডিও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশী কূটনীতিক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও এ্যাটকোর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ক্রেস্ট দেয়া হয়।
সব টিভি চ্যানেল চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় মালিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশী স্যাটেলাইট ভাড়া করে যে টাকাটা খরচ করতেন, সেটা কিন্তু বেচে গেল। এখন এ টাকা কি করবেন এটাও আমার প্রশ্ন আছে। কিছু দানটান করে দিয়েন গরিব মানুষের জন্য। কারণ, অনেক টাকাই আপনাদের বেচে যাচ্ছে, এটাও বাস্তবতা। এছাড়া টাকাটা পাঠানোতেও নানা ঝামেলা ছিল।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলা, দুর্গম পাহাড়, চরাঞ্চলে বা হাওর অঞ্চলের মানুষের কাছে টেলিমেডিসিন সেবা পৌঁছে দেয়া, শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ই-এডুকেশন পদ্ধতি চালুর কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, একটা স্যাটেলাইটের নির্দিষ্ট সময় থাকে ১৫ বছর। এর মধ্যে আরেকটা আমাদের আনতে হবে। এর মধ্যে পাঁচ বছর হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টা তৈরি শুরু করেছি, সময় থাকতে নিয়ে আসব। সেটা আমরা একটু বড় আকারে করতে চাই।
’৯৬ সালে সরকারে আসার পর বেসরকারী খাতে টিভি চ্যানেল উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তখন অনেকেই এত অভিজ্ঞ ছিল না, অতটা সাড়া পায়নি। কিন্তু যারা চেয়েছিল তাদের সবাইকেই টেলিভিশন দিয়ে দিই। কর্মসংস্থান, সংস্কৃতি জনগণের সঙ্গে জড়িতদের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করা ও বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে এ বিষয়ে উদার ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার হারাবার কিছু নেই, আমি বাবা-মা, ভাই সব হারিয়েছি। মানুষ একটার শোক সইতে পারে না, আমরা দুই বোন একইদিনে সব হারিয়েছি। সেই বেদনা শোক বুকে নিয়েও আমার ফিরে আসা। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর একটাই কর্তব্য মনে করি, সেটা হচ্ছে আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, এদেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। সেই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোটাই হচ্ছে আমার একমাত্র কর্তব্য।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণার সময় অনেকের হাসাহাসি ও বিদ্রƒপ করার ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একমাত্র দল যাদের একটা অর্থনৈতিক নীতিমালা আছে। আমাদের দলীয় কিছু সিদ্ধান্ত এবং ঘোষণাপত্র আছে, আমরা ভবিষ্যতে দেশটাকে কিভাবে গড়ে তুলতে চাই। জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করেই আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। সেই পদক্ষেপ হিসেবেই আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’র ঘোষণা দিয়েছিলাম। ডিজিটাল শব্দটা, এটা আমার জানার কথা নয়। কারণ, আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। এই শব্দটা আমাকে দিয়েছিল সজীব ওয়াজেদ জয়। সে কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েট, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট, পরবর্তীতে আবার সে হার্ভার্ডে মাস্টার্সও করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা একটা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে দেশ চালাচ্ছি। আমরা ক্ষমতায় আছি পাঁচ বছর, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করব, কিছু টাকাপয়সা বানাব, আর আমি চলে যাব, সেটা না। তার সরকার বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সবদিক থেকে দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনসহ থ্রিজি-ফোরজি সেবার বিস্তার করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করে ইন্টারনেট সেবা গ্রাম পর্যায় নিয়ে যাওয়ার কাজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অনেক মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কথা সবাই জানি, এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেন, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াব, কারও কাছে হাত পেতে চলব না। আজকে আমরা যে বাজেট দিই তার পুরো অর্থ নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারি। বিদেশী কিছু ঋণ সহযোগিতা থাকে, সেটা মাত্র ১০ থেকে ১৪ শতাংশের বেশি না। বাকিটা আমরা নিজস্ব অর্থায়নে করার মতো সামর্থ্য অর্জন করেছি। এই ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ সময় তিনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন।
বিসিএসসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বেসরকারী চ্যানেল মালিকদের অতীতে এ্যাপস্টার-৭ এবং এশিয়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য মেগাহার্জ প্রতি ফ্রিকোয়েন্সির জন্য প্রতিমাসে ৪ হাজার ডলার ব্যয় করতে হতো। সেখানে দেশী চ্যানেলগুলোর জন্য প্রতিমাসে স্যাটেলাইটের ভাড়া ২ হাজার ৮১৭ ডলার নির্ধারণ করেছে বিসিএসসিএল।