ইউজিসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু

20

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিয়োগে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে কমিশন সচিবকে ওএসডি করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। এছাড়া ডজনখানেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার ইউজিসির পূর্ণ কমিশন সভায় সংস্থাটির বিতর্কিত সচিব ড. মো. খালেদকে ওএসডি করা হয়। মঞ্জুরি কমিশনে সহকারী পরিচালক পদে নিজের মেয়েকে নিয়োগ দিতে প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষার হলের খাতায় লেখে দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তদন্ত কমিটি হয়। তদন্তের সত্যতা মেলার পর তাকে ওএসডি করা হয়। প্রথমে তাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত হলেও চাকরির মেয়াদ অল্প কিছুদিন থাকায় বরখাস্ত না করে ওএসডি করা হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক রেজাউল করিম হাওলাদার। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। এই পরিচালক নিজের এলাকায় মসজিদের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাঁদাবাজি করার প্রমাণ পাওয়ার পর তাকে বরখাস্ত করা হয়। অন্যদিকে পূর্ণ কমিশনের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেয়ার অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় সাবেক চেয়ারম্যানের পিএস শাহীন সিরাজের বিরুদ্ধেও। বিদেশি স্টাডি সেন্টারের অবৈধ অনুমোদন দেয়ার নামে কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগে ফেঁসে যাচ্ছেন অতিরিক্ত পরিচালক দুর্গা রানী সরকার। এছাড়াও আর্থিক অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ নেয়া, এমনকি চুরিরও অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন শাখার আরও ১৩ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইউজিসির প্রশাসনিক শাখার কর্মকর্তারা। তারা বলেন, প্রায় ১ যুগ ধরে দুর্নীতিবাজ এ সিন্ডিকেট লালন-পালন করত কমিশনের সচিব। যখন যে চেয়ারম্যান এসেছেন তখন তাকে বধ করতেন সচিব। এবার নিজের মেয়েকে নিয়োগ দিতে গিয়ে মহাকেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ায় ফেঁসে যান সচিব। এখন সচিবের সিন্ডিকেটের অন্যান্য কর্মকর্তারা ধরা পড়বেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনৈতিকভাবে সুবিধা আদায়, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজন নিয়োগ কখনও নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন খাওয়া, অবৈধ নিয়োগে বৈধতা দেয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় পূর্ণ কমিশনে। তবে যেসব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন তাদের পদোন্নতিসহ ভালো পদে পদায়ন করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয় কমিশনে।
এ ব্যাপারে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা কমিশন খাওয়ার অভিযোগ উঠা মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পূর্ণ কমিশনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতদিন এখানে কি হতো সেটা তার দেখার বিষয় না। অভিযোগ প্রমাণিত হলেই তাকে ওএসডি করা হবে।
কমিশনের একজন সদস্য বলেন, ইউজিসিতে এতদিন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ভালো পদে পদায়ন হতো। এবার নতুন চেয়ারম্যান যারা এতদিন ভালো কাজ করেছেন, সুনাম ধরে রেখেছেন কাজের স্বীকার হিসেবে তাদেরও পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে পজিটিভ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জানা গেছে, মঞ্জুরি কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় শাখা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এ শাখায় সচিবের পছন্দের লোক ঢুকানোর চেষ্টা করেও গত কয়েক বছর ব্যর্থ হন তিনি। সেখানে কর্মরত কর্মকর্তাদের ইমেজ ভালো হওয়ায় সাবেক দুইজন চেয়ারম্যান তাদের সরাননি। নতুন চেয়ারম্যান তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে পজিটিভ রিপোর্ট পান, এরপর সম্প্রতি একজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন। এরপর থেমে নেই সিন্ডিকেট সদস্যরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের সরানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, ইউজিসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তাদের মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছেন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব শাহীন সিরাজ। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান অবসরে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই পিএস পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। সাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রটোকল অফিসার এম এ ওয়ারেছ কমিশনের চেকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৬ সালে বরখাস্ত হলেও পরে সাবেক চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী তাকে তার প্রটোকল অফিসার হিসেবে পুনর্বহাল করেন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত বছর তুরস্কের একটি প্রতিনিধি দলকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি ডিউটি ফ্রি শপ থেকে টাকা চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই বছরের মাঝামাঝি সময় ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. নাছিমা রহমান ও একই বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আতোয়ার রহমান খুলনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দশ লাখ টাকা ঘুষ চান। তদন্তে এর প্রমাণও মেলে। সবশেষে এদের চাকরিচ্যুতও করা হয়। এর আগের ২০১৭ সালে গত ১৮ সেপ্টেম্বরে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ইউজিসির কার্যালয় থেকে র‌্যাবের হাতে আটক হন সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ। ওইদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের কর্মকর্তা ওমরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে কারাগারেই মারা যান। অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের নানা অভিযোগ রয়েছে সম্প্রতি পরিচালক হওয়ার একজনের বিরুদ্ধে তাকে এর আগে নানা অভিযোগে দুইবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সর্বশেষ একটি অনিয়মের অভিযোগে তাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি তাকে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে পদায়ন করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে প্রথমবার সাময়িক বরখাস্ত হন ২০০৩ সালের ৫ এপ্রিল। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের পদ অনুমোদনের জন্য ঘুষ দাবি করায় ২০১৮ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাডি সেন্টার বা অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস অনুমোদন করিয়ে দেয়ার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে অতিরিক্ত পরিচালক দুর্গা রানী সরকারের বিরুদ্ধে। একাধিক অভিযোগ ওঠার পরও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাকে নজরদারিতে রেখেছেন কমিশন।