কাজিরবাজার ডেস্ক :
অক্টোবরে শুরু হচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ কাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ টার্মিনালের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করবেন। প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই টার্মিনালে থাকছে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়ন। এখন ঠিকাদারের সঙ্গে আর্থিক চুক্তি সইয়ের পর শুরু হবে নির্মাণ কাজ। এই টার্মিনাল নির্মিত হলে বছরে শাহজালাল বিমানবন্দরের যাত্রী সক্ষমতা দাঁড়াবে দুই কোটিতে। ২০২৩ সালে টার্মিনালটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিমান সচিব মহিবুল হক বলছেন, আশা করছি আগামী অক্টোবরের মধ্যেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধন করা হবে। এর আগে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, বড় প্রকল্প হওয়ায় টেন্ডার ঘোষণা, টেন্ডার আবেদন সংগ্রহ, দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজে সময় বেশি লাগছে। তাই চলতি সেপ্টেম্বরে নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ হবে ২ লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটার জমির ওপর। নতুন এ টার্মিনাল ভবন নির্মাণের পাশাপাশি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ করা হবে। স্থানান্তর ও সম্প্রসারণ করা হবে কার্গো ভিলেজ, ভিভিআইপি কমপ্লেক্স, হ্যাঙ্গার ও পদ্মা ওয়েল ডিপো।
তৃতীয় টার্মিনালের নক্সায় রয়েছে ২৪টি বোর্ডিং ব্রিজ, যদিও প্রথম ধাপে নির্মাণ করা হবে ১২টি। পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী বাকি ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ ধাপে-ধাপে নির্মাণ করা হবে। যাত্রীদের তৃতীয় টার্মিনালে চেক ইন বেল্ট থাকবে ১৩টি। আগত যাত্রীদের চাপ সামলাতে ও যানজট এড়াতে বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযোগ সড়কেও আসবে পরিবর্তন।
একই সঙ্গে হোটেল লি মেরেডিয়ানের কাছেই বিমানবন্দরে ঢোকার মূল সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বিমানবন্দরের সঙ্গে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত করতে সাবওয়ে নির্মাণ করা হবে। নতুন কার্গো ভিলেজের আয়তন হবে ৪১ হাজার ২০০ বর্গমিটার। ভিভিআইপি কমপ্লেক্স ৫ হাজার ৯০০ বর্গমিটার। পার্কিং ্এ্যাপ্রোণ হবে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। এছাড়া, র্যাপিড এক্সিট এ্যান্ড কানেকটিং ট্যাক্সিওয়ে, তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে মূল এয়ারপোর্টের সড়কের কানেকটিভিটি তৈরি করা হবে।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শুরুতেই তৃতীয় টার্মিনালে যাত্রী সেবার মানের দিকে নজর দেয়া হবে। এক্ষেত্রে টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ আউটসোর্সিংয়ে দেয়া হবে। টেন্ডারের মাধ্যমে এই আউটসোর্সিংয়ের কাজ ছেড়ে দেয়া হবে বেসরকারী খাতে। এতে সেবার মান বাড়বে, সহজ হবে ফ্লাইট পরিচালনা।
হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি বছরে ৮০ লাখ এবং কার্গো হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি বছরে দুই লাখ টন। বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং ইতোমধ্যে সক্ষমতা হারিয়েছে। এ বছর যাত্রী হ্যান্ডেলিং ক্যাপাসিটি হারানোরও আশঙ্কা করছেন কর্তৃপক্ষ।
কারণ, ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে বছরে প্রায় ৯০ হাজার বিমান ওঠানামা করে। গত বছরে (২০১৮) সক্ষমতার চেয়ে বেশি ৯০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয় প্রধান এই বিমানবন্দর। সে অনুপাতে বাড়েনি বোর্ডিং ব্রিজ, লাগেজ বেল্ট, ইমিগ্রেশন চেকিং পয়েন্ট, পার্কিং-বেসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো সুবিধা। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। এই প্রেক্ষাপটেই শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় মূল টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে ২৪ লাখ বর্গফুট জমির ওপর তৃতীয় টার্মিনাল করতে যাচ্ছে সরকার।
এ প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬১০ কোটি ৪৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। নির্মাণ কাজে অর্থায়ন করবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে কাজ শুরু করে ২০২১ সালের এপ্রিলে তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সফট লঞ্চিং করা হবে। কিন্তু তৃতীয় টার্মিনালের জায়গায় অবস্থিতি বিভিন্ন স্থাপনা অপসারণ ও স্থানান্তর করতে বেশ সময় লেগেছে। তৃতীয় টার্মিনালের জায়গায় ছিল কার্গো ভিলেজ, ভিভিআইপি কমপ্লে´, হ্যাঙ্গার, পদ্মা ওয়েল ডিপো প্রভৃতি। টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরুর আগে এগুলো অপসারণ করতে সময় লেগেছে। এছাড়াও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে জায়গা লিজ দিয়েছিল বেবিচক। সেসকল স্থানেও লিজ গ্রহীতারা স্থাপনা তৈরি করে। মূল নির্মাণকাজ শুরুর আগে এসব স্থাপনা স্থানান্তর ও অপসারণ করতে বিলম্ব হয়েছে। আবার দীর্ঘমেয়াদে লিজ নেওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান বেবিচকের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা করে। মামলা নিষ্পত্তি করতে ও স্থাপনা অপসারণ করতে বিলম্বের কারণে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু করতে প্রায় দেড় বছর বিলম্ব হয়েছে।
এ নির্মাণ কাজের জন্য গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে বেবিচক। তবে দরপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা ১ মাস বাড়ানো হয়। আগের দরপত্র সংগ্রহের সময়সীমা ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যা বাড়ানো হয় ১৮ মার্চ পর্যন্ত। একই সঙ্গে দরপত্র খোলার তারিখও এক মাস পিছিয়ে ১৯ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটি একটি বড় প্রকল্প বিধায় অনেক তথ্য-উপাত্ত ও জামানত জমা দেয়ার ব্যাপার থাকায় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই সময়সীমা বাড়ানো হয়।
জানা যায়, দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়নে ২টি জয়েনভেঞ্চার কোম্পানিকে বিবেচনায় রাখা হয়। এরমধ্যে সর্বনি¤œ দরদাতা হিসাবে কাজ পেয়েছে কোরিয়া ও জাপানের যৌথ কোম্পানি স্যামসাং ও মিতসুবিসি জয়েনভেঞ্চার। এখন এই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সময় নিয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। এর আগে ২০১৫ সালে বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ ও সম্প্রসারণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন ও খসড়া মাস্টার প্ল্যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থাপিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১১ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ কাজ প্রকল্পের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে যৌথভাবে পরামর্শক নিয়োগ দেয় সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। এই চারটি প্রতিষ্ঠান হলো, জাপানের নিপ্পন কায়ো, ওরিয়েন্টাল কনস্যালটেন্ট গ্লোবাল, সিঙ্গাপুরের সিপিজি কনসালটেন্ট, বাংলাদেশের ডিজাইন কনসালটেন্টস লিমিটেড। তারা ইতোমধ্যে প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে। এছাড়া, তৃতীয় টার্মিনালের বিস্তারিত ডিজাইন রিভিউ, মূল নির্মাণ কাজের দরপত্রের খসড়া, নির্মাণকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তদারকি করবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে এই টার্মিনালে পূর্ণাঙ্গ সেবা নিশ্চিত করতে বিমানবন্দরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নতির পরামর্শ দিয়েছেন এভিয়েশন খাতের বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের আধুনিকায়নসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো সুবিধা না বাড়লে যাত্রীরা এ টার্মিনালের পুরো সুবিধা বাড়বে না। এ প্রসঙ্গে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের সাবেক সিইও ইমরান আসিফ বলেন, সব জায়গার সুবিধা সমানভাবে না বাড়লে সুবিধা ঠিকঠাকমতো না পাওয়াই স্বাভাবিক।
অপর বিশ্লেষক ওয়াহিদুল আলম বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন ফ্লাইট অপারেশনের জন্য শাহজালালে ক্রমবর্ধমান যাত্রীদের চাপ সামলাতে এখন থেকেই পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান চূড়ান্ত করে দ্রুত ওই বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে শাহজালালে দ্বিতীয় রানওয়ে নির্মাণের কাজও শুরু করতে হবে।
বেসরকারী বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুব আলীও সম্প্রতি জানিয়েছেন, শীঘ্রই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেছেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। বর্তমানে কোন যাত্রীর লাগেজ যাতে খোয়া না যায়, সেজন্য সার্বক্ষণিক মনিটরিং হয়। তৃতীয় টার্মিনাল নির্মিত হলে সেবার মান আরও বাড়বে।’