কাজিরবাজার ডেস্ক :
উদ্বাস্তু, শরণার্থী, বাস্তুচ্যুত যে নামেই ডাকা হোক না কেনÑ আশ্রয় পাওয়া ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি করার অপতৎপরতায় যে লিপ্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। দু’দফায় নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে রাজি না হয়ে উল্টো নানা শর্ত উত্থাপন করে শোডাউনের নেপথ্যের ঘটনা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। যে কারণে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক মোবাইল সেবা এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে নিয়োজিত থাকা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (আরআরআরসি) কমিশনার ও সাত ক্যাম্প ইনচার্জকে (সিআইসি)। আশ্রিত এ রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারসহ সব মহলে ব্যাপক উৎকণ্ঠা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনায় সরকারী ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারী কার্যক্রমে পরিবর্তন ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। ইতোমধ্যে প্রশাসনিক এ্যাকশন শুরু হয়েছে। এ এ্যাকশন দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সব এনজিও সংস্থার কার্যক্রম প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে গড়ে ওঠা সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। মোবাইল সেবা বন্ধে মোবাইল ও সিম আটক করে তেমন কোন ফলাফল আসবে না। মূলত মোবাইল অপারেটরগুলোর স্থাপিত সীমান্ত এলাকার সব মোবাইল টাওয়ার উঠিয়ে ফেলতে হবে। পুনঃস্থাপন করতে হবে এমন স্থানে যেখান থেকে সীমান্তের ওপারে ফ্রিকোয়োন্সি থাকে না। এছাড়া রোহিঙ্গাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে তাদের কাছে সার্বক্ষণিকভাবে থাকা বাংলাদেশী মুদ্রা যাতে না যায় সে ব্যবস্থাও করতে হবে। এসবের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা কোন অবস্থাতে যাতে এনআইডি বা স্মার্ট কার্ড এবং পাসপোর্ট না পায় সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় ক্যাম্পের বাইরে ঘোরাঘুরির কোন সুযোগ নেই। এদের ক্যাম্প এলাকার মধ্যে থাকার আন্তর্জাতিক বিধান রয়েছে। অথচ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এসবের কিছুই মানা হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা একদিকে নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী যেমন পাচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন ধরনের কাজ করে বাড়তি আয় রোজগারও করে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহ জানায়, শুধু মোবাইল সেবা বন্ধ করে পরিপূর্ণ কোন সুফল আসবে না। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শ’ শ’ দোকান। এসব দোকান প্রতিষ্ঠা করেছে রোহিঙ্গারা। খদ্দেরও রোহিঙ্গারা। সবজি, মাছ, মাংস, পান, কাপড়, স্বর্ণ, ওষুধ, ফল, প্রসাধনী, সিমেন্ট, চাল, ঘড়ি, ফার্মের মুরগিসহ এমন কোন পণ্য নেই যা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে না। জুয়েলারি দোকান রয়েছে শ’ শ’। উখিয়ার বালুখালিতে যে বিশাল বাজার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রোহিঙ্গারা এর নাম দিয়েছে বলি বাজার। মিয়ানমারের মংডুতে প্রসিদ্ধ একটি বাজারের নাম হচ্ছে বলি বাজার। এর বাজারের নামের অনুকরণেই রোহিঙ্গারা এদেশে এ বাজারের নামকরণ করেছে। আর মোবাইল সিমের দোকান একেবারে হাতের নাগালে। বাংলাদেশী সবকটি মোবাইল অপারেটরের সিম মিলেছে গত দুবছর ধরে। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব সিম রোহিঙ্গাদের হাতে দিয়েছে মোবাইল অপারেটররা তাদের এজেন্ট ও ডিলারের মাধ্যমে। অপরদিকে, সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা কর্মাচারীরা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে থাকার সুবাদে আর্থিক পর্যায়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ দীর্ঘ সময়ের। এ কারণেই সরকারী পর্যায়ের নিয়োগপ্রাপ্তদের আমূল পরিবর্তন ঘটানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। অবশ্য ইতোমধ্যে আরআরআরসি ও সাত ক্যাম্প ইনচার্জকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহারের তালিকায় অনেকের নাম রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলায় রক্ষায় যারা নিয়োজিত রয়েছে এদের মধ্যেও ব্যাপক রদবদলের সময় এসেছে।
এদিকে, বাংলাদেশী মোবাইল সেবা এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করার সরকারী ঘোষণার পর মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের চার মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিমের কদর বেড়ে গেছে। বাংলাদেশী সিম দিয়ে যেমন সীমান্তের এপার ওপারে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়, অনুরূপভাবে মিয়ানমারের সিম দিয়েও একই যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। এক্ষেত্রে তফাৎটা হচ্ছে মিয়ানমারের সিম দিয়ে বাংলাদেশী সিম সংবলিত মোবাইলে কথা বলা যাবে না। অনুরূপভাবে বাংলাদেশী সিম দিয়ে মিয়ানমারের সিম সংবলিত মোবাইলে কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু একই দেশের সিম দিয়ে কথা বলার সুযোগ অবারিত। বাংলাদেশে আশ্রিত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে ৮ লাখেরও বেশির কাছে বাংলাদেশী মোবাইল সিম রয়েছে। দীর্ঘ দু’বছর ধরে এদেশীয় সিম রোহিঙ্গারা দেদার ক্রয় করে ব্যবহার করে আসছে। শুধু তাই নয়, এপার থেকে বাংলাদেশী সিম ওপারেও পাঠিয়েছে রোহিঙ্গারা, তাদের স্বজনদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য। সরকার রোহিঙ্গা কেন্দ্রিক মোবাইল সেবা বন্ধের নির্দেশনা প্রদানের পর এখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সিমের প্রতি ঝুঁকেছে। শুধু তাই নয়, আগেও যেমন ক্ষুদ্র আকারে সে দেশের সিম এপারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এখন বড় আকারে সে দেশের সিম ব্যবহার হতে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মুখে আলোচিত হচ্ছে, তাদের ভাষায় ‘বর্মাইয়্যা সিম’ এর কথা। ইতোমধ্যেই ৩২ আশ্রয় শিবিরে মিয়ানমারের সিম ব্যবহারের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ সুবাদে মিয়ানমার থেকে চালানে চালানে সে দেশের চার অপারেটরের সিম কার্ড যে চলে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশী সিমকার্ডের সেবা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এককভাবে কিভাবে বন্ধ করা যাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা, উখিয়া টেকনাফে সাড়ে চার লাখেরও মানুষের মাঝে এদেশীয় সিম কার্ডের ব্যবহার রয়েছে। এক্ষেত্রে সূত্র জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকাজুড়ে যে ১২টি অপারেটরের টাওয়ার রয়েছে সেই টাওয়ার সরাতে হবে এবং তা এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে ফিকোয়েন্সি সীমান্তের ওপারে না থাকে। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালি, থাইনখালি, গয়ারমারা, টেকনাফের চাকমারকূর, পুটিবুনিয়া, নয়াপাড়া ও লেদা এলাকায় স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে সীমান্তের দূরত্ব সর্বনি¤œ অর্ধকিলোমিটার এলাকা। মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় সে দেশের মোবাইল অপারেটররা তাদের যে টাওয়ার প্রতিষ্ঠা করেছে সেগুলো থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে উখিয়া টেকনাফ এলাকায় ফ্রিকোয়েন্সি মিলছে। সে দেশের বর্তমানে চলমান চার মোবাইল অপারেটরে মধ্যে দুটির টেকওয়ার্ক বেশি পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে একটির নাম এমপিপি। যার নেটওয়ার্ক বেশি বিস্তৃত।
সূত্র মতে, সীমান্তের ওপারে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশী মোবাইল সিম ব্যবহার হয়ে আসছে। সে দেশের পেরাংকুল, কাউয়ার বিল, মেরুল্লাসহ সীমান্তের দক্ষিণে প্রায় দশ কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশী সিমের নেটওয়ার্ক সহজে মিলে যায়। অনুরূপভাবে মিয়ানমারের মোবাইল সিমের নেটওয়ার্ক উখিয়া টেকনাফের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে অবাধ মিলে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কাছে শুধু মোবাইল সিম নয়, ৩২ আশ্রয় শিবিরে থ্রি-জি নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট ও স্থানীয়ভাবে ব্রডব্যান্ড লাইনও ব্যবহার হয়ে আসছে। রোহিঙ্গারা তাদের ভাষার আরাকান টাইমস, রোহিঙ্গা নিউজ, আরাকান টুডে, রোহিঙ্গা টিভিসহ আরও বিভিন্ন নামের অনলাইন টিভি দেখার নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশী সিম ব্যবহারের কারণে এরা একে অপারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সংযোগরক্ষা করে যাচ্ছে। কিন্তু অনলাইন রেডিও, টিভি নিউজ পোর্টালগুলো সার্বক্ষণিক সাধারণ রোহিঙ্গাদেরও তাদের পরিকল্পনামাফিক উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। আর এ সুবাদে গত ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করার দ্বিতীয় বর্ষে লাখো রোহিঙ্গার জমায়েত ঘটেছে।