কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমের চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রকাশ কেন্দ্র করে সতর্ক অবস্থানে বাংলাদেশ। এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশের স্থল সীমান্তে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে সিলেট সীমান্তের অনেক পয়েন্টে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন সিলেট সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা। কোন কোন সীমান্ত পয়েন্টে বাড়তি বিজিবি মোতায়েনসহ সিলেটের অনেক সীমান্ত একপ্রকার সিল করে দেয়া হয়েছে।
এনআরসি থেকে ১৯ লাখ বাসিন্দার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়লেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় বাংলাদেশ। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন, এই নাগরিক পঞ্জি প্রকাশে প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না। এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশের স্থল সীমান্তের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এনআরসি ইস্যুটি ভারতের। ভারতকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভারতে থাকা রাষ্ট্রহীন নাগরিকদের বিষয়ে ভারতকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনভাবেই দায় নেয়া উচিত হবে না।
কড়া নিরাপত্তা আর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে শনিবার প্রকাশিত হয়েছে অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা। স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় প্রকাশিত চূড়ান্ত এ তালিকায় নাম উঠেছে মোট ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের। বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন। এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছে ১১ লাখেরও বেশি হিন্দু বাঙালি। ছয় লাখের কিছু বেশি মুসলমান। বাকি দুই লাখের মধ্যে রয়েছে বিহারী, নেপালী, লেপচা প্রভৃতি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমের চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) থেকে ১৯ লাখ বাসিন্দার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়লেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় বাংলাদেশ। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না।
এ প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অসমের এনআরসির বিষয়টি উত্থাপন করেছিলাম। যেখানে এমনিতেই ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে আমরা খুব কষ্টে আছি, আবার অসমের ৪০ লাখ মানুষের কথা মিডিয়ায় শুনতে পাচ্ছি। তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অসমের এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না।
উল্লেখ্য, ঢাকা সফরকালে অসমের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবেও বিষয়টিকে ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রানিয়াম জয়শঙ্কর।
তবে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলছেন, ভারতের অসমে এনআরসি নিয়ে যা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং ভারতের মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের এক ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ অবশ্যই আছে। অতীতে, ১৯৯৮-১৯৯৯ সালের দিকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে অনেককে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল ভারত। তাই এবারও বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশে সতর্কতা : গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কাশ্মীর ইস্যুর পর অসমের এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশের স্থলসীমান্তের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে সিলেট সীমান্তের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক পয়েন্টে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন সিলেট সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা। কোন কোন সীমান্ত পয়েন্টে বাড়তি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সিলেটের অনেক সীমান্ত একপ্রকার সিল করে দেয়া হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বাড়তি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ইস্যুটিকে পুঁজি করে দেশের উগ্রবাদী, জঙ্গী সংগঠন ও ইসলামী সংগঠনগুলো যাতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে পারে এজন্য এবং বাড়তি অতৎপরতা চালাতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কোন কোন ইসলামী দলের উপর কড়া গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, সীমান্তের যেসব পয়েন্ট দিয়ে মানুষের যাতায়াত বেশি, সেসব পয়েন্টগুলো একপ্রকার সিল করে দেয়া হয়েছে। এসব পয়েন্টে যাতায়াতের ওপর কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি চলছে বাড়তি গোয়েন্দা নজরদারি। সীমান্ত পয়েন্টের আশপাশে থাকা টহল চৌকিতেও অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির পাশাপাশি সীমান্ত পয়েন্টের কাছাকাছি থাকা পুলিশ ও র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। গোয়েন্দারাও বিষয়টি সম্পর্কে বাড়তি নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।
র্যাবের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই তারা বিষয়টি সম্পর্কে সরকারসহ নানা দিক থেকেই অবহিত হয়েছেন। তারা তৎপর থাকার পাশাপাশি নজরদারিও বাড়িয়েছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশের এন্টি টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এ্যাডিশনাল ডিআইজি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কাশ্মীর ও অসমের এনআরসি দুইটিই ভারতের ইস্যু। ভারতীয় ইস্যুর সঙ্গে তারা কোনভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়। তবে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবহিত। সরকারীভাবে সতর্ক থাকতে বাড়তি তাগাদা রয়েছে। সে মোতাবেক আমরা সতর্ক আছি। ইস্যু দুইটিকে পুঁজি করে কোন গোষ্ঠী বা সংগঠন বা দল অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যাতে না ঘটাতে পারে, এজন্য সংশ্লিষ্টদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ভবিষ্যতে এনআরসি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই প্রয়োজনীয় আগাম সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।
কড়া নিরাপত্তায় তালিকা প্রকাশ : কড়া নিরাপত্তা আর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা। এ নিয়ে শনিবার সকাল থেকেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ছিল আসামসহ গোটা ভারতে। স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় প্রকাশিত চূড়ান্ত এ তালিকায় নাম ওঠেছে মোট ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের। বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন। এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছে ১১ লাখেরও বেশি হিন্দু বাঙালী। ছয় লাখের কিছু বেশি মুসলমান। বাকি দুই লাখের মধ্যে রয়েছে বিহারি, নেপালী, লেপচা প্রভৃতি। এর আগে, এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ পড়েছিল ৪৩ লাখ মানুষের নাম। এর মধ্যে দুই লাখ অবাঙালী, ২৬ লাখ হিন্দু বাঙালী, বাকি সব বাঙালী মুসলমান। সেখান থেকে চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়েছে ১৯ লাখের বেশি নাম। খসড়ার সময় নাগরিকপঞ্জিতে আবেদনকারীর মোট সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ ২৭ হাজার ৬৬১ জন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্থানীয়দের বারবার আশ্বস্ত করছেন তালিকায় নাম না থাকাদের এখনই বের করে দেয়া হবে না। সংশোধিত তালিকা থেকে বাদ পড়া আবেদনকারীরা তালিকায় নাম ওঠাতে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আপীল করতে পারবেন। এ বিষয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল জানিয়েছেন, যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। এখনই তারা বিদেশী নন। আগামী ১২০ দিনের মধ্যে বিদেশী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন তারা। আবেদন জানাতে পারবেন সুপ্রীমকোর্টেও।
এ নিয়ে মোট এক হাজার ট্রাইব্যুনাল খোলা হবে বলে জানিয়েছে সরকার। যদিও, এখন এর সংখ্যা মাত্র একশ’। সেপ্টেম্বরে আরও দুইশ’টি খোলা হবে। ট্রাইব্যুনালের আবেদন বিফলে গেলেও সুযোগ থাকবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হাইকোর্ট, তারপর সুপ্রীমকোর্টের দ্বারস্থ হতে পারবেন। এ প্রক্রিয়া চলাকালীন কাউকে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হবে না বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। তবে, এনআরসি প্রকাশের পর বেশ দোটানায় পড়েছে বিজেপি ও আসাম সরকার। কারণ, বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে বিপুল সংখ্যক হিন্দু বাঙালী রয়েছেন। এদের মধ্যে সিংহভাগই আসামের প্রকৃত বাসিন্দা বলে মনে করছে রাজ্য সরকারও। মুখ্যমন্ত্রী এ সমস্যা নিয়ে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। পাশাপাশি, আসাম গণ পরিষদ দাবি তুলেছে, এ তালিকা বাতিলের। কারণ তাদের মতে, আসামে বহিরাগত আছে ৪০ লাখেরও বেশি।
এনআরসি প্রকাশকে কেন্দ্র করে আসামজুড়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় শুক্রবার থেকেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তালিকা প্রকাশের পর ব্যাপক সতর্কতা জারি করা হয়েছে রাজ্য জুড়ে। মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত ১৭ হাজার পুলিশ সদস্য। অতিরিক্ত ২২ হাজার আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যও পাঠানো হয়েছে। আসাম রাইফেলস ও আসাম পুলিশের দাঙ্গা প্রতিরোধ বাহিনী টহলদারি শুরু করেছে। একাধিক স্পর্শকাতর জেলায় ১৪৪ ধারা জারি হচ্ছে।