কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত ৫ আগষ্ট ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বাতিলের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাশ্মীরে কারফিউ জারি করা হয়। সেনাবাহিনীসহ আধা-সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মারধর এবং নির্যাতনের অভিযোগ করেছে বিবিসি। নির্যাতিত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে এক প্রতিবেদনে এই দাবি করা হয়।
বিবিসি সংবাদদাতা সামির হাশমি দক্ষিণ কাশ্মীরের অন্তত ৬টি গ্রাম ঘুরেছেন। গত কয়েক বছর ধরে গ্রামগুলো ভারত বিরোধী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থানের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।
ভুক্তভোগীরা বিবিসি সাংবাদিককে জানিয়েছেন, লাঠি দিয়ে তাদেরকে মারা হয়েছে এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে।
সেই গ্রামগুলোর ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
একটি গ্রামের বাসিন্দা অভিযোগ করেন, ভারতের সংসদে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক বাড়িতে তল্লাশী চালায় সেনাবাহিনী। গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই অনেককে গ্রেফতার করেছে। তাদের কোন খোঁজ নেই।
এক গ্রামের দুই ভাই বিবিসির সংবাদদাতাকে বলেন,‘সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদেরকে ব্যাপক মারধর করেছে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা কী করেছি? কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই শুনেনি। তারা শুধু মারতেই থাকে।’
একজন বলেন,‘আমার শরীরের প্রতিটি অংশে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আঘাত করে। তারা আমাদের লাথি দেয়, লাঠি ও তার দিয়ে মারে, বৈদ্যুতিক শক দেয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে যখন আমরা অজ্ঞান হয়ে যায়, তখন বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।’
নির্মম নির্যাতনের কথা স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন,‘লাঠি দিয়ে মারার সময় আমরা যখন চিৎকার করছিলাম, তখন আমাদের মুখ বন্ধ করার জন্য মুখে কাদা ভরে দেয়। আমরা বারবার বলতে থাকি যে আমরা নির্দোষ। কিন্তু তারা কোনো কথাই শোনেনি।’
দুই ভাইয়ের একজন বলেন,‘সেনাবাহিনীর নির্যাতনের একপর্যায়ে আমরা তাদের বলি যে আমাদের এভাবে মেরো না দয়া করে। এর চেয়ে গুলি করো। একপর্যায়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুনয় করি যেন আমাদের উঠিয়ে নেয়।’
সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে এক তরুণ জানান, সেনা সদস্যরা গ্রামের কিশোর ও তরুণদের মধ্যে কে কে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে তাদের নাম বলতে চাপ দেয়। এই তরুণ ও কিশোররা বিগত কয়েক বছর ধরে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের প্রতিমূর্তি হিসেবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
তরুণটি সেনা সদস্যদের কাছে তাদের নাম জানে না বলে জানায়। তারপর সেনা সদস্যরা তার চশমা, জুতা ও কাপড় খুলতে নির্দেশ দেয়। তারপর তার ওপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। অল্পবয়সী সেই তরুণকে নানাভাবে নির্যাতন করে সেনা সদস্যরা।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তরুণটি বলেন,‘আমার গায়ের কাপড় খোলার পর তারা আমাকে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পেটায়, প্রায় দু-ঘন্টা যাবত। যখনই অজ্ঞান হয়ে যেতাম, তারা বৈদ্যুতিক শক দেয় আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য।’
মিথ্যা অভিযোগ সম্পর্কে এক তরুণ জানায়, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খবর জোগাড় করে না দিলে তার নামে মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করা হবে বলে তাকে হুমকি দিয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এই কাজে অস্বীকৃতি জানালে তাকে এমন নির্যাতন করা হয় যে দুসপ্তাহ পরেও সে সোজা হয়ে বিছানায় শুতে পারছে না।
তরুণটি বলে, ‘এ রকম অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো। তারা আমাদের পশুর মতো মেরেছে।’
নির্যাতনের শিকার আরেকজন বলেন অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন সেনা সদস্য তাকে মাটিতে ফেলে রড, লাঠি, তার দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে।
সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে,‘আমার জ্ঞান প্রায় ছিলই না। তারা আমার দাড়ি ধরে এত জোরে টানে যে আমার মনে হচ্ছিল যে আমার দাঁত উপড়ে আসবে।’ পরে জ্ঞান ফিরলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজনের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে একজন সৈন্য তার দাড়ি পুড়িয়ে দিতে চাইলেও আরেকজন সৈন্য বাধা দেয়ায় তার দাড়ি পুড়ানো হয় নি।’
সংবাদদাতা সামির হাশমি এক তরুণের দেখা পান, যার ভাই দুবছর আগে ভারত শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা হিজবুল মুজাহিদীন গোষ্ঠীতে যোগ দেয়।
তরুণটি জানায়, একটি ক্যাম্পে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং নির্যাতনের কারণে তার পা ভেঙে যায়।
তিনি বলেন,‘আমার হাত পা বেঁধে প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি সময় মারতে থাকে।
তবে, ভারতের সেনাবাহিনী নিযার্তনের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও প্রমাণসাপেক্ষ’ নয় বলে দাবি করেছে।
বিবিসিকে দেয়া এক বিবৃতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা ‘অভিযোগ অনুযায়ী কোনো নাগরিকে নির্যাতন করা হয়নি।’
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আমান আনন্দ দাবি করেন,‘নির্যাতনের কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেনি। এই অভিযোগগুলো শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা থেকে করা হয়েছে।’
বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হলেও ‘সেনাবাহিনীর নেয়া পদক্ষেপের কারণে নিহত বা আহত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি’ বলেও মন্তব্য করেন কর্নেল আনন্দ।
বিবিসিকে দেয়া বিবৃতিতে সেনাবাহিনী মন্তব্য করে যে তারা, পেশাদার একটি সংস্থা যারা মানবাধিকারের বিষয়টি বোঝে এবং সম্মান করে এবং তারা, অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে।
বিবিসির সংবাদদাতা বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখতে পান যে সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের প্রতি সহানুভূতিশীল।