কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৯ জেলায় এক হাজার ৩শ’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে পানি ঢুকে যাওয়ায় অবকাঠামো, আসবাবপত্র, শিক্ষা উপকরণসহ ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত ২৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বন্যায় বিভিন্ন জেলায় প্রায় দেড় হাজার হাইস্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩২ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সর্বশেষ হিসেবে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও সকল প্রতিষ্ঠানের তথ্য কেন্দ্রে আসেনি। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডেঙ্গুবিরোধী নানা কর্মসূচীতে ব্যস্ত আছেন, তাই বন্যার তথ্য সংগ্রহের কাজে একটু পিছিয়ে পড়েছে। অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বন্যায় ক্ষতির তথ্য সংগ্রহে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করে বলছেন, তাদের এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে এখন পর্যন্ত সারাদেশ থেকে পাঠানো তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে গত একমাসের বন্যায় সারাদেশে এক হাজার ৩০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করে বন্ধ হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৫, কুড়িগ্রাম সদরে ৫৭, চিলমারী ৩১, নাগেশ্বরী ২১টি, ফুলবাড়ী ২৮, ভুরুঙ্গামারী ৩২, রৌমারী ২৫, চর রাজিবপুর ৫৫, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ৬৩, সাদুল্লাপুর ২৯, লালমনিরহাটে আদিতমারী ২১, সদর ৩২, হাতীবান্ধা ৩৩, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ ১২, ডিমলা ২৫, ডোমার ১৭, বগুড়ার ধুনট উপজেলায় ২৭, সারিয়াকান্দি ৭৮, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর ২৯, বেলকুচি ৯, শাহজাদপুর ৫২, সদরে ২৪, নওগাঁর আত্রাই উপজেলায় ৩২, সদরে ৫, মান্দায় ২৫ প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাবনার ফরিদপুর ৩৮, ভাঙ্গুড়া ২১, বেড়া ২৭, মাদারীপুর জেলার শিবচর ২৬, সদরে ১২, রাজবাড়ীর পাংশায় ৫, গোয়ালন্দে ৭, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় ৫, কক্সবাজার চকরিয়া ১২৫, পেকুয়ায় ৩১, রাঙ্গামাটি সদরে ৭, কাউখালীতে ৯, বরকলে ৮, জুড়াছড়িতে ৬, লংগদুতে ২, বাঘাইছড়িতে ১৫, বিলাইছড়ি ৯, ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ২১, পরশুরামে ২, ফুলগাজীতে ২১, কুমিল্লা সদরে ২, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় ৮, সুনামগঞ্জ ১৮ ও বরগুনার আমতলী উপজেলায় ৫ প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে বন্যায়।
অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতদিনই তথ্য দিচ্ছে। ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরও কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা। বন্যায় ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জানার জন্য কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা এবং প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করছে।
অধিদফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার উপ-পরিচালক নুরুল আমিন বলেছেন, নিয়মিত তথ্য নেয়া হচ্ছে। বন্যায় উত্তরবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে তথ্য এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে। তবে সরকারের প্রস্তুতি বেশ ভাল। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন মেরামতের পাশাপাশি অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে।
এদিকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় প্রায় দেড় হাজার হাইস্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৩২ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদিও কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মূলত ডেঙ্গু প্রতিরোধ কাজ নিয়েই ব্যস্ত আছে। কর্মকর্তারাও সেদিকেই ব্যস্ত। ফলে বন্যার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।
মাউশির পরিচালক (মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন) অধ্যাপক আমীর হোসেন বলছেন, কিছুদিন আগে আমরা একটি হিসাব নিয়েছিলাম। মোটামুটি একটা তথ্য এসেছিল। এখন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডেঙ্গু বিরোধী নানা কর্মসূচীতে ব্যস্ত আছেন, তাই বন্যার তথ্য সংগ্রহের কাজ একটু বন্ধ আছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তাদের কাছে এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা।
তবে মাউশি’র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) রুহুল মমিন জানিয়েছেন, বন্যায় আক্রান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১১৯টি প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্রও খোলা হয়েছে। মাউশি’র মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে। পরবর্তীতে ক্ষয়-ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা হবে। আমরা একটি তালিকা করেছি। মন্ত্রণালয় চাইলেই আমরা তথ্য দিতে পারব। যাতে সে অনুসারে মন্ত্রণালয় কাজ করতে পারে।
জানা গেছে, বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমি, অবকাঠামো, আববাবপত্র ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে জামালপুর জেলায় ৪০৮ হাইস্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। মাউশি ৯ আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে ৬৪ জেলার শিক্ষা কার্যক্রম তদারক করে। সবকটি কার্যালয় থেকেই বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রাথমিক প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে দেখা গেছে, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ৫৭০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ৪০৮ প্রতিষ্ঠান জামালপুরের। ময়মনসিংহে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দশ কোটি টাকা।
অন্যান্য আঞ্চলিক কার্যালয় ও বিভাগের মধ্যে রাজশাহীর ১৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক কোটি ২২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রামের ৩৬ প্রতিষ্ঠানে ৭৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকার, ঢাকা অঞ্চলে ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা, সিলেট অঞ্চলে ২৫২ প্রতিষ্ঠানে দশ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং রংপুর অঞ্চলে ৫২৯টি প্রতিষ্ঠানে ৯ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করা হয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) অধীনে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইইডি’র প্রধান প্রকৌশলী দেয়ান মোঃ হানজালা বলেছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে কাজ করছেন মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীরা। বন্যা শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কার ও মেরামত কাজ শুরু করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপদকালীন সংস্কার কাজের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রয়েছে।