স্টাফ রিপোর্টার :
সারা দেশের মতো সিলেট জুড়েও ছেলেধরা আতংক বিরাজ করছে। পদ্মা সেতুর জন্য ‘মানুষের কাটা মাথা’ চাওয়া হয়েছে এ রকম একটি গুজব ছড়িয়ে একটি কুচক্রী মহল ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরণের গুজবে কান না দেওয়ার জন্য বার বার আহবান জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সতর্ক থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতেও বলা হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেও গতকাল মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আর দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের ছাতকে ছেলেধরা সন্দেহে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন স্থানীয় জনতা। এ সব ঘটনায় আতংক বিরাজ করছে অভিভাবকদের মধ্যে। অনেক অভিভাবকই ভয়ে-আতংকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলে এই গুজবের ডালপালা বেশি বিস্তৃত হচ্ছে। পাশাপাশি একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে নানা কল্প কাহিনী দিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় এ রকম গুজব ছড়িয়ে দিয়ে আতংক ও একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীর চেষ্টা করছে। যার মধ্যে অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে।
কমলগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তি (৫০) নিহত য়েছেন। গত শনিবার (২০ জুলাই) রাত ১০ টার দিকে রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রবিবার অজ্ঞাতনামা ৩৫০ থেকে ৪০০ জনকে আসামী করে কমলগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে।
দেওড়াছড়া চা বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি সুবোধ কুর্মী জানান, দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় স্থানীয় লোকজন সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে অজ্ঞাত পরিচয়ের ঐ ব্যক্তিকে আটক করে তার নাম পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর অসংলগ্ন কথাবার্তায় ছেলেধরা সন্দেহে তাকে চা বাগান শ্রমিকরা চা বাগান অফিসে নিয়ে আসেন। এতে কয়েক শত শ্রমিক বিক্ষুব্ধ হয়ে অফিস চত্বরে ঢুকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতরভাবে আহত করে। পরে দেওড়াছড়া চা বাগানের প্রধান ব্যবস্থাপক মোস্তফা জামানের নির্দেশনায় এ চা বাগানের মেডিক্যাল সুপারভাইজার গোপাল দেব তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ১২টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। খবর পেয়ে রাতে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নিহত লোকটি এ এলাকার ছিল না। চা শ্রমিকরা সন্দেহজনক ঘোরাফেরায় তাকে আটক করে নাম পরিচয় জানতে চাইলে সে সঠিক জবাব দিতে পারেনি। পরে ছেলে ধরা সন্দেহে গণ পিটুনিতে সে আহত হলে গুরুতর আহতাবস্থায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে সে মারা যায়। থানার ওসি আরো জানান, এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৩৫০ থেকে ৪০০ জনকে আসামী করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে লাশটির ময়নাতদন্ত করানো হচ্ছে। এখন লাশের পরিচয় উদঘাটনের চেষ্টা করছি। পরিচয় না পাওয়া গেলে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের পক্ষ থেকে লাশটির সৎকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনাটির রহস্য জানার জন্য পুলিশ জোরালোভাবে তদন্ত করে দেখছে ।
এদিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে ২ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। কমলগঞ্জ থানার এএসআই আনিছুর রহমান জানান, রবিবার সন্ধ্যায় সাড়ে সাতটার দিকে রহিমপুর ইউনিয়নের দেওঢ়াছড়া চা বাগান এলাকায় এক অপরিচিত যুবককে সন্দেহজনকভাবে ঘুরাফেরা করতে দেখে স্থানীয়রা তাকে আটক করে। পরে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয় জনতা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তিনি জানান, আটক যুবকের নাম সানাউল্যাহ (২৫)। সে বি-বাড়িয়া জেলার সরাইল থানার বাসিন্দা। সে মানসিক ভারসাম্যহীন।
অপরদিকে মুন্সীবাজার ইউনিয়নের উবাহাটা গ্রাম এলাকা থেকে ছেলে ধরা সন্দেহে শহীদুর রহমান (৩২) নামের যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। রোববার বিকাল সাড়ে ৫টায় এ ঘটনা ঘটে। আটক শহীদুর রহমান কমলগঞ্জ উপজেলার ৫নং কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সরইবাড়ি গ্রামের মখলিছুর রহমানের পুত্র। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে সে ঐ রাস্তা দিয়ে সিলেট যাওয়ার কথা বলেছে। ঘটনার খবর পেয়ে থানার পুলিশ উবাহাটা ও দেওড়াছড়া এলাকা থেকে অভিযুক্ত দুই যুবককে আটক করে থানায় নিয়ে যান।
কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান জানান, দুই যুবককে আটক করে থানায় আনা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ছাতক থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : সুনামগঞ্জের ছাতকে ছেলেধরা সন্দেহে (৫৫) বছর বয়সের এক ব্যক্তিকে পিটুনি পর পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। গতকাল রবিবার বিকেলে উপজেলার সদর ইউনিয়নের মল্লিকপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
ছাতক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল বলেন, বিকেলে ওই এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে পিটুনি দেয় এলাকাবাসী। পরে ইউপি চেয়ারম্যান পুলিশকে অবগত করলে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে আসে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, তাকে উদ্ধারের পর ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দিতে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান তিনি একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। এমন কি তিনি তার নাম পরিচয় কিছুই বলতে পারছেন না।
এদিকে ছেলেধরা গুজবে কান না দেওয়ার জন্য ছাতক থানা পুলিশের পক্ষ থেকে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।