বড়লেখা থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারের বড়লেখায় স্ত্রীকে আগুন দিয়ে পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় স্বামী সাহেদ আহমদকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে বড়লেখা থানা পুলিশ। গত রবিবার (২৩ জুন) দিবাগত রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাহেদ আহমদ বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মুছেগুল গ্রামের আনু মিয়ার ছেলে।
গত ৪ জুন ভোররাতে উপজেলার বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মুছেগুল গ্রামে বিক্রির জন্য কানের সোনার অলংকার না পেয়ে আছমিনা বেগম (২৫) নামের ওই গৃহবধূকে তার স্বামী সাহেদ আহমদ আগুনে পুড়িয়ে দগ্ধ করে। আগুনে ওই গৃহবধূর শরীরের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে যায়। এই ঘটনায় গত মঙ্গলবার (১১ জুন) ওই গৃহবধূর বাবা ছমির উদ্দিন বাদী হয়ে আছমিনার স্বামী ও শাশুড়িকে আসামি করে বড়লেখা থানায় একটি মামলা করেন। মামলার পরদিন পুলিশ আছমিনার শাশুড়িকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে করাগারে পাঠায়।
অপরদিকে আগুনে পোড়ানো দরিদ্র গৃহবধূ আছমিনা বেগমের চিকিৎসার সব দায়িত্ব নেন বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক। তাঁর উদ্যোগে বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ওই গৃহবধূর চিকিৎসা চলছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পরপরই স্ত্রী হাসপাতালে রেখে উধাও হয়ে যান স্বামী সাহেদ আহমদ। স্থানীয়ভাবে খবর পেয়ে পুলিশ নির্যাতিতার বাড়িতে যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে আইনী সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপর তাঁর পরিবার থানায় দুজনের নামে মামলা দেয়। এই ঘটনায় মামলার পরই স্বামীকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে নামানো হয়।
কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার পর সে কোনো মুঠোফোন ব্যবহার করেনি। যার কারণে তার অবস্থান জানা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু পুলিশ থেমে থাকেনি। সাহেদ পালিয়ে অবস্থান নিতে পারে এমন সব সম্ভাব্য স্থানে অভিযান চালানো হয়। চট্টগ্রাম ও ফেনীতে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়। এরই মধ্যে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের কাছে খবর আসে তিনি ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকায় কাজ করেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার রাতে সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে অংশ নেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বড়লেখা থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) শরীফ উদ্দিন ও সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) পিযুষ কান্তি দাস।
গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক সোমবার (২৪ জুন) রাত সাড়ে ১১টায় বলেন, ‘মঙ্গলবার তাকে আদালতে পাঠানো হবে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭দিনের রিমান্ডেরও আবেদন করা হবে। তাকে গ্রেপ্তার করেতে মাঠে দুটি চৌকস টিম কাজ করে। ওর মুঠোফোন ছিল না। তাই অবস্থান জানা কঠিন হয়ে পড়ে। গোপন সংবাদে কামরাঙ্গীর চরে অভিযান চালানো হয়। সেখানে একটি ব্যাগ তৈরির কারখানা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পর সে পালিয়ে ঢাকা চলে যায়। এরপর নিজেকে আত্মগোপন রাখতে ব্যাগ তৈরির ওই কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেয়।’
প্রসঙ্গত, প্রায় তিন বছর পূর্বে বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মুছেগুল গ্রামের আনু মিয়ার ছেলে সাহেদ আহমদের সাথে একই ইউনিয়নের জফরপুর গ্রামের হতদরিদ্র ছমির উদ্দিনের মেয়ে আছমিনা বেগমের বিয়ে হয়। তাদের দুই বছরের একটি ছেলে রয়েছে। বিয়ের পর থেকে প্রায়ই স্বামীর মারধরের শিকার হতেন আছমিনা বেগম।
ঘটনার কয়েকদিন আগে আছমিনার বেগমের কানের স্বর্ণের অলংকার বিক্রি করার চেষ্টা করেন স্বামী সাহেদ আহমদ। বিষয়টি বুঝতে পেরে আছমিনা বেগম বাবার বাড়িতে গিয়ে সেখানে অলংকার রেখে আসেন। ঘটনার দিন ভোর রাতে আছমিনার বেগমের কাছে সোনার অলংকার চান সাহেদ আহমদ। তখন আছমিনা বেগম তা বাবার বাড়িতে রেখে আসার কথা জানান। এতে সাহেদ আহমদ ক্ষুব্ধ হয়ে ঘরে থাকা আছমিনা বেগমের সব কাপড় চোপড় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেন। আছমিনা বেগম বাধা দিতে গেলে তাঁকে শারীরিকভাবে আঘাত করে আগুনের মধ্যে চেপে ধরে রাখেন। এতে আছমিনা বেগমের শরীরের বেশিরভাগ অংশই ঝলসে যায়। এরপর মুমূর্ষু অবস্থায় আছমিনা বেগমকে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেখে স্বামী সাহেদ আহমদ পালিয়ে যান। জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে খবর পেয়ে আছমিনা বেগমের বাবা-মা ও বোন বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে দেখতে পান। ওই দিনই চিকিৎসকের পরামর্শে আছমিনাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঁচদিন চিকিৎসা দিয়ে গুরুতর অগ্নিদগ্ধ অবস্থাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আছমিনা বেগমকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। এরপর থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি বাবার বাড়ি ছিলেন। দরিদ্র পিতার পক্ষে মেয়ের উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছিল না। স্থানীয়ভাবে খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ও নির্যাতিতা গৃহবধূর বাবার বাড়ির লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে। এ সময় পুলিশ ওই গৃহবধূকে আইনি সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আছমিনার বাবা বাদী হয়ে আছমিনার স্বামী ও শাশুড়িকে আসামি করে মামলা করেছেন। এই অবস্থায় বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক আছমিনা বেগমকে ঢাকায় পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর উদ্যোগ নেন