শাহ আলম শামীম কুলাউড়া থেকে :
সিলেট আখাউড়া সেকশনের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল স্টেশন সংলগ্ন বড়ছড়া ৯নং রেল ব্রিজের উপর ২৩ জুন রবিবার রাত পৌনে বারটায় স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছে দুই শতাধিক যাত্রী।
এতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রেল সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন সোমবার ২৪ জুন সকাল ৮টায় সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে দুর্ঘটনাস্থলে ৭টি বগি রেখে ৬টি বগি নিয়ে ভোর রাত ৩টায় কিছু যাত্রী নিয়ে আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে কুলাউড়া স্টেশন ছেড়ে যায়। এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্ত:নগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কুলাউড়া স্টেশনে আসার পর সিলেটের যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। পরে যাত্রীরা সড়ক পথে সিলেটে যান। সোমবার সন্ধ্যা থেকে কুলাউড়া জংশন স্টেশন থেকে কুলাউড়া-ঢাকা ও কুলাউড়া-চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়া ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
নিহতদের পরিচয় : নিহত ৪ যাত্রীর মধ্যে ৩জন নারী ও একজন পুরুষ। তন্মধ্যে কুলাউড়া পৌরসভার টিটিডিসি এরিয়ার বাসিন্দা ও ঠিকাদার আব্দুল বারির স্ত্রী মানোয়ারা পারভীন (৪৮)। সিলেটের মোগলাবাজারের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আব্দুল বারির মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০) ও বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট থানার ভান্ডারখোলা গ্রামের আকরাম মোল্লার মেয়ে সানজিদা আক্তার (২০)। এরা দু’জন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের নাসিং ইন্সটিটিউটের ছাত্রী। নিহত পুরুষ যাত্রী মোঃ কাউছার আহমদ(২৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছির নগর উপজেলার ধরমন্ডল গ্রামের মৃত নুর হোসেনের ছেলে। কাউছারের মা ২ বছর ও বাবা ১ বছর আগে মারা গেছেন। তার খালা হাজেরা বেগম লাশ গ্রহণ করেন। নিহত ৪ জনেরই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আহতরা কুলাউড়া হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাজার মুসলিম এইড হাসপাতাল, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল ও সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
দুর্ঘটনা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের বক্তব্য : বরমচাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান, প্রভাষক মোঃ আলী তরিক, প্রভাষক আহসান মিরাজ, পারভেজ আহমদ, সুলতান আহমদ ও ভাটেরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম জানান, রাত আনুমানিক সাড়ে ১১ টা ৪০ মিনিটে আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন বরমচাল স্টেশন অতিক্রমকালে খুব দ্রুত গতি ছিলো। স্টেশন অতিক্রম করার পরপরই এক বিকট শব্দ শুনা যায়। সাথে সাথে মানুষের আর্তচিৎকার শুরু হয়। দুর্ঘটনা বুঝতে পেরে সাথে স্থানীয় কালা মিয়া বাজারের মসজিদের মাইকে ট্রেন দুর্ঘটনার ঘোষণা দেয়া হয় এবং স্থানীয় লোকজনকে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। সাথে সাথে আশপাশের শত শত মানুষ ঘুম থেকে জেগে দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং উদ্ধার কাজে অংশ নেন। এদিকে দুর্ঘটনা কবলিত বগির প্রায় ৩৫ জন যাত্রী রাতে আশ্রয় নেন বরমচাল টিকরা জামে মসজিদে। স্থানীয়দের মতে, দ্রুত গতি আর অতিরিক্ত যাত্রীর কারণেই ট্রেনটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে। তবে বড়ছড়া নামক পাহাড়ী ছড়ার উপর নির্মিত ৯নং রেল ব্রিজটির ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণকারীরা : ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রেলওয়ে নিরাপত্তা পুলিশ, কুলাউড়াসহ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন থানা পুলিশ, সহকারি পরিচালক মো. শাহজাহানের নেতৃৃত্বে ২ প্লাটুন বিজিবি, র্যাব এবং উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কুলাউড়া, মৌলভীবাজার ও সিলেটের ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট রাতে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। মাঝরাতে ঘন অন্ধকার থাকায় উদ্ধারকারী দল সাময়িক ট্রেনের বগিগুলোতে উদ্ধার কাজ বন্ধ রাখে। সকালবেলা পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু করলেও কোন হতাহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সোমবার সকাল ৯টায় আখাউড়া থেকে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে ছিটকে পড়া বগি উদ্ধার কাজ শুরু করে।
ট্রেন যাত্রীদের বক্তব্য : দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিলেটের ফটোগ্রাফার কে এম এ তাহের বলেন সিটে বসা, হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন যাত্রী উপড়ে পড়েন। বিকট শব্দ ও কান্নার আওয়াজ শুনি। ভাগ্যিস জানালার পাশে ছিলাম ঝুলন্ত বগি থেকে কোন রকম মাথাটা বের করে পাঁ বাড়ালে দেখি আমি পানিতে। জাহেদ মিয়া, আলম মিয়া, মাসুদ আহমেদ, তোফায়েল, মিজানুর, আব্দুর রশীদ বলেন, চোখে ঘুম ঘুম ভাব, হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো মনে হলো। কি যেন আমাদেরকে ট্রেনের পিছন দিক দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরই বিকট শব্দের পর আমরা দেখি রেললাইনের পাশের জমিতে পড়ে আছি। সাথে সাথে আমাদের সাথে থাকা শিশু ও মহিলাদের আর্তনাদ শুনে উদ্ধার কাজে লেগে যাই। এদিকে ভয়াবহ ট্রেন দুঘটনা কবলিত আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ঢ বগির যাত্রী পাবনার মো. আল আমিন ও মো. স¤্রাট পারভেজ জানান, তারা ১৪ জন মিলে সিলেটে মাযার জিয়ারতে আসেন। সড়কপথ বন্ধ থাকায় তারা ট্রেনের টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দুর্ঘটনার পর ভয়ে তারা ট্রেন থেকে নেমে টিকরা জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। মসজিদে রাত কাটান। ভোর ৭টায় তারা সড়ক পথে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তারা ক্ষোভের সাথে জানান, এটা কোন ধরনের ট্রেন হলো। টিকিট কেটে সিটে বসলাম। কিন্তু কাঁধের উপর লোক দাঁড়িয়ে ছিলো। ট্রেনের টিকিটধারী যাত্রীর চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী ছিলো দাঁড়ানো। আর যাত্রা শুরুর পর ট্রেনটি খুবই দ্রুত গতিতে চলছিলো। তখনই মনে হয়েছিলো, কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিছু বুঝে উঠার আগেই বিকট শব্দে বগিটি ব্রিজ থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়।
ঘটনা তদন্তে পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন : আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ায় দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে কমিটির প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চীফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জলিল, চিফ পিএসপি মইনুল ইসলাম, চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) চিফ সুজিপ কুমার। অপরদিকে কেন্দ্রিয় তদন্ত কমিটির ৫ সদস্য হলেন- চিফ সিগন্যাল এন্ড কমিনিউকেশন মঈনুল ইসলাম, সিওপিএস সুজিত কুমার, রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম, অতিরিক্ত সচিব মো. মুজিবুর রহমান, চীফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা : দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রবিবার রাতে তাৎক্ষণিকভাবে সিলেটে বিভাগীয় কমিশনার মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেন। সোমবার সকাল ৮টায় দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন,অতিরিক্ত সচিব মুজিবুর রহমান।
এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার পর রাত কিংবা পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। বেলা ১২ নাগাদ কুলাউড়া রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জুয়েল হোসাইন মোবাইল ফোনে জানান, প্রায় ২শ মিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকাল থেকে ২ শতাধিক শ্রমিক মেরামত কাজ করছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রেললাইন মেরামত কাজ সম্পন্ন হবে।
কুলাউড়া হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও প:প: কর্মকর্তা ডাঃ নূরুল হক জানান,রাত ১২ টা থেকে সোমবার ৩ টা পর্যন্ত ৬৭ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন নিহত। তবে কুলাউড়া ফায়ার সার্ভিস সূত্র আহত ৬৭ জন জানালেও নিহত ৫ জন দাবী করছে।
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালালের জানান, দুর্ঘটনার সাথে সাথে স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। পরবর্তীতে খবর পেয়ে মৌলভীবাজারের প্রায় সবক’টি থানার পুলিশ উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ জানা যায়নি। ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। রেলওয়ের স্পেশালিস্ট ছাড়া দুর্ঘটনার কারণ নিরুপন করা যাবে না।
সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী জানান, যত দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভব রেললাইন মেরামত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, সোমবার সন্ধ্যা থেকে কুলাউড়া-ঢাকা ও কুলাউড়া-চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
৩০০ প্রাণ বাঁচালেন মঈন : কুলাউড়ার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকায় গতকাল রবিবার রাতে ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে। এ সময় ২টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে খালের মধ্যে ছিটকে পড়েছে। আর ৩টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেললাইন বেঁকে যায়। ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশকে এমন ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার খবর জানান মঈন উদ্দিন নামে এক যুবক। এর ফলে প্রাণহানি থেকে বাঁচল ৩০০ যাত্রী ।
এ ব্যাপারে কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ ইয়ারদৌস হাসান বলেন, রাত ১২টার কিছুক্ষণ আগে এক ব্যক্তি ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর জানায়। দুর্ঘটনার পরপরই ওই যুবক ৯৯৯ নম্বরে ফোন না দিলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটতো। খবর পেয়ে তখনই ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্য রওনা দেই আমরা। ওসি বলেন, হতাহতদের উদ্ধারে কাজ করেছে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বিজিবি। ট্রেনের অন্য যাত্রীদেরও নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।