কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মুজিব আদর্শ বুকে ধারণ করে জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করার জন্য দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করে বলে জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের ওপর বার বার আঘাত এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি অর্জনের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের নাম এখনও সমুজ্জ্বল। আওয়ামী লীগের শিকড় এতই গভীরে প্রোথিত যে, শত ষড়যন্ত্র করে কেউ উপড়ে ফেলতে পারেনি, বরং আওয়ামী লীগের ওপর যতবার আঘাত এসেছে, ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়েছে- আওয়ামী লীগ ততই শক্তিশালী হয়েছে। তাই গত ৭০ বছরের ইতিহাসে উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের নামই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগকে হীরার সঙ্গে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হীরা যত কাটা হয়, তত বেশি উজ্জ্বল হয়। একইভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগের ওপর যত আঘাত এসেছে, ততই দলটি উজ্জ্বল ও শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসার কারণেই বারবার আঘাত ও নির্যাতনের পরও শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষের প্রতি কর্তব্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলেই বার বার আঘাত আসা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ৭০ বছর ধরে টিকে আছে। আওয়ামী লীগ দিনে দিনে যে ভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, তা ধরে রেখে দলকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। তাই দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে মুজিবাদর্শে দীক্ষিত হতে হবে, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবই।
গতকাল সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা স্বাধীনতা হারিয়েছিল। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে। এই মীরজাফর তো গালিতেই পরিণত হয়েছে। এরপর দুইশ বছর ব্রিটিশ বেনিয়ারা শাসন করেছে এই ভূখন্ড। দুইশ বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেই দুইশ বছর আগে হারিয়ে ফেলা স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতাকে আওয়ামী লীগই আবার ফিরিয়ে এনেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, ইতিহাসবিদ-কলামিস্ট বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ এমপি, দক্ষিণের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাত। সূচনা বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
আওয়ামী লীগের জন্মদিনে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সঙ্গে দেশের মানুষের কল্যাণ, মুক্তি, স্বাধীনতা ও সকল অর্জনের ইতিহাস জড়িত। একটি দেশের জন্য আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বিশাল আত্মত্যাগ করেছেন। অন্য কোন রাজনৈতিক দল নেই যে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য এত আত্মত্যাগ যেটা আওয়ামী লীগ করেছে। আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে বার বার আঘাত ও ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ হচ্ছে হীরের টুকরার মতো। হীরাকে যতই টুকরো করা হয় ততই উজ্জ্বল হয়, তেমনি আওয়ামী লীগের ওপর যতবার আঘাত এসেছে ততই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী ও উজ্জ্বল হয়েছে। যতবেশি আঘাত এসেছে আওয়ামী লীগ ততবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ বছরে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের চিত্রই পাল্টে গেছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন সম্মান পাচ্ছে, উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে এদেশের মানুষ কিছু পেয়েছে। ৪১ ভাগ থেকে দারিদ্র্যের হার আমরা ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি। এই হার আরও নামাব। অনেক উন্নত দেশেও এখন দারিদ্র্যের হার ১৭/১৮ ভাগের মতো রয়েছে। সেসব উন্নত দেশ থেকে দারিদ্র্যের হার আমরা একভাগ হলেও নামাব, এ লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে জনকল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে মনে রাখতে হবে, এ দলটির উত্তরসূরিরা যেভাবে আত্মত্যাগ করে গেছেন, সকলকে তাদের আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, উচ্চমানের চিন্তাভাবনা করবে, আর সাধারণভাবে জীবনযাপন করবে। যে কোন মহৎ অর্জনের পেছনে বড় ত্যাগের ঘটনা জড়িত আছে। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি মেনে কাজ করে যাচ্ছি বলেই দেশ আজ উন্নতির চরম শিকড়ে উন্নীত হয়েছে।
আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, দেশের একেকটা যখন অর্জন হয়, মনে হয় নিশ্চয় আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) বেহেস্ত থেকে নিশ্চয়ই দেখছেন। তিনি দেখছেন বাংলাদেশের এখন কেউ আর না খেয়ে থাকে না, কেউ ছেঁড়া কাপড় পরে চলে না। তিনি বলেন, আমরা দেশের সকল মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। দেশের একটি মানুষ গৃহহীন থাকবে না, প্রতিটি মানুষকে আমরা ঘর তৈরি করে দেব। কারণ আমি সবসময় মনে করি, দেশের একটি মানুষ কষ্ট পেলে বঙ্গবন্ধুর আত্মা কষ্ট পাবে। আজ দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুত। দেশের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
বার বার নির্বাচনে ভোট দিয়ে দেশসেবার সুযোগ প্রদানের জন্য ভোটারসহ দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাদের ওপর আস্থা-বিশ্বাস রেখেছে। বার বার নির্বাচনে ভোট দিয়ে আমাদের দেশ সেবার সুযোগ দিয়েছে। সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে বলেই আমরা দেশের এত উন্নয়ন করতে পেরেছি। তাই আমরা কোন অহমিকা করব না, দেশের মানুষ সারাবিশ্বে যেন মাথা উঁচু করে মর্যাদা নিয়ে চলতে পারে- সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
দেশবাসীর কাছ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিশ্বাস-আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ওয়ান ইলেভেনের পর ২০০৯ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল মাত্র ২৯টি আসন পেয়েছিল। জনগণের আস্থা-বিশ্বাস তারা হারিয়ে ফেলেছিল। ক্ষমতায় থাকতে বল্গাহীন দুর্নীতি, গ্রেনেড হামলা, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি, হাওয়া ভবনের নামে দেশের মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার, দুঃশাসন সৃষ্টি এবং মানুষের সম্পদ লুট করে খাওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষ বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতি অতিষ্ঠ ছিল। তাই তারা নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করে।
আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী ও জনগণের দলে পরিণত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, মওলানা ভাসানী যখন আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ন্যাপ করেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন। দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে জাতির পিতা মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন এবং সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়ে তিনি দলকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন, গোটা জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই জনগণের শোষণ-বঞ্চনার কথা বলেছেন, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ও কল্যাণে সংগ্রাম করে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি নেতাকর্মীকে আত্মত্যাগের মানসিকতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে দেশসেবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা দেশকে শুধু উন্নতিই করছি না, আমরা শতবছরের পরিকল্পনা দিয়েছি। আগামী একশ’ বছরের জন্য ডেল্টা প্ল্যান দিয়েছি। আমরা ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। ২০৭১ সাল পর্যন্ত আমরা কেউ বেঁচে থাকব না। তবুও আগামী প্রজন্মের জন্য ও দেশের উন্নয়নে আমরা এক শ’ বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবই।